ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটছে রুমা এলাকার লোকজনের
১০ বছর ধরে রুমা উপজেলা সদরে মানুষ এমন পরিস্থিতি কখনো দেখেননি। উপজেলা সদরে ব্যাংক লুটের চেষ্টা, ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে অপহরণ— সব মিলে অন্যরকম ভীতিকর পরিবেশে দিন কাটাচ্ছে আতঙ্কিত লোকজন।
পুলিশের টহল থাকে কিনা জানতে চাইলে এলাকাবাসী বলেন, ‘পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের যতক্ষণ দেখি মনে সাহস লাগে। এরপর ভয় লাগে।’
এলাকার লোকজন বলছেন, ‘আগে এই গরমের দিনে ঘরের দরজা খুলে ঘুমাতাম। এখন ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিই।’
রুমা উপজেলার বেশির ভাগ বাসিন্দাদের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। অপ্রয়োজনে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। আর কেউ বের হলেও সন্ধ্যার আগে ফিরছেন। ঘরেও লোকজন নিজেদের নিরাপদ মনে করছে না।
তবে পুলিশ বলছে, লোকজনের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) নূরে আলম মিনা বলেন, বান্দরবানের কয়েকটি থানায় পুলিশ সদস্যের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হয়েছে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
রুমায় সোনালী ব্যাংকের শাখায় গত মঙ্গলবার রাত সোয়া আটটার দিকে হামলা চালায় অস্ত্রধারীরা। ব্যাংকের ভল্টে থাকা ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা নিতে পারেনি তারা। তবে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র ও ৪১৫টি গুলি লুট করে। অস্ত্রধারীরা ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রুমা থেকে তাকে উদ্ধার করে র্যাব।
পর দিন থানচি থানার দুটি ব্যাংকের শাখা থেকে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা লুট করে অস্ত্রধারীরা। এই ঘটনায় পৃথক ছয়টি মামলা করা হয়। এদিকে ঘটনার পর রামুও থানচিতে ব্যাংকিং লেনদেন এখনো বন্ধ রয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন লোকজন।
রুমায় সোনালী ব্যাংকের শাখায় ডাকাতির সঙ্গে নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা জড়িত বলে প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। অন্যদিকে স্থানীয় লোকজন বলছেন, থানচিতে হামলার সঙ্গেও একই গোষ্ঠী জড়িত।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, কেএনএফ সদস্যরা হামলার আগে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। এতে উপজেলা পরিষদ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। অস্ত্রধারীরা বান্দরবান-রুমা সড়কের উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনের অংশে দুই পাশে ব্যারিকেড দেয়।
হামলায় কেএনএফের শতাধিক সদস্য অংশ নিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের বেশির ভাগের পরনে ইউনিফর্ম ছিল। সদস্যরা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে সোনালী ব্যাংক, স্থানীয় মসজিদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবনের দিকে যায়। ইউএনওর বাসভবনের দিকে তারা আনসার সদস্যদের অস্ত্র কেড়ে নেয়।
লোকজনের চোখে-মুখে আতঙ্ক
রুমা উপজেলা সদরে আজ শনিবার সকাল ৯টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজনের কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক, পরিস্থিতি এমন—‘আবার কখন কী হয়ে যায়’।
বান্দরবানের রুমা উপজেলা গেটের বিপরীতের চা দোকানি মো. আলমগীর। তিনি বলেন, ভয়ে লোকজন ঘর থেকে বের হচ্ছে না। বাইরে থেকে লোকজন আসা-যাওয়া কমে গেছে। তাই দোকানে গ্রাহক কম। লোকজন না থাকায় ও ভয়ে সন্ধ্যা নামলে দোকান বন্ধ করে দেন তিনি। অথচ গত মঙ্গলবারের আগেও রাত ১১টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতেন আলমগীর। আজ তিনি বলেন, ‘এভাবে আর কিছুদিন চললে দোকান বন্ধ করে দিতে হবে।’
বান্দরবান রুমা সড়কের উপজেলা সদর এলাকায় চাঁদের গাড়ি নিয়ে বসে আছেন চালক প্রণব বড়ুয়া। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লোকজন এলাকায় যারা আছে তারা কেউ আসা-যাওয়া করছে না। বাইরে থেকেও কেউ আসছে না। ভয়, আবার কখন কী হয়ে যায়।’
মোটরসাইকেলে যাত্রী আনা নেওয়া করেন সিন মং। মঙ্গলবারের ঘটনার পর থেকে যাত্রী পাচ্ছেন না। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এভাবে আর কয়েক দিন চললে তাঁকে বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
বাজার কোন ক্রেতা নেই
রুমা উপজেলার একমাত্র বড় বাজার রুমা। আজ শনিবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায় দোকানপাট খোলা, তবে ক্রেতা নেই।
রুমা বাজারের সবজি বিক্রেতা আবদুর রশিদকে দেখা যায় বসে থাকতে। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই ব্যক্তি কিছুক্ষণ পর পর ঝিমোচ্ছেন। কাছে যেতেই ক্রেতা এসেছে ভেবে বললেন, ‘কী লাগবে?’ পরিচয় জানার পর বলেন, ‘সারা দিনে ২০০ টাকা বিক্রি করতে পারছি না। যেখানে মঙ্গলবারের ঘটনার আগে বিক্রি করতাম ২ হাজার টাকা।’
তার পাশের মুদি দোকানি মোহাম্মদ রাজু জানালেন আগে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার মালামাল বিক্রি করতেন। এখন এক হাজার টাকার সদাইও বিক্রি হয় না।
জানতে চাইলে রুমা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি অঞ্জন বড়ুয়া বলেন, এখানে ২৮০টি দোকান রয়েছে। উপজেলা সবচেয়ে বড় বাজার এটি। আতঙ্কগ্রস্ত লোকজন বাজারে আসছে না। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে পুলিশ প্রশাসনকে ক্রেতারা যাতে নির্বিঘ্নে বাজার আসতে পারে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
মঙ্গলবারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের আতঙ্ক এখনো কাটেনি
মঙ্গলবারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মসজিদের ইমাম নুরুল ইসলাম। সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখায় হামলার আগে সন্ত্রাসীরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে ধরতে মসজিদে যান। মসজিদের ইমাম সহ সব মুসল্লিদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখেন অস্ত্রধারীরা।
রুমা উপজেলা মসজিদ এর ইমাম নুরুল ইসলাম আজ শনিবার দুপুরে বলেন, ঘটনার পর থেকে মসজিদ থেকে আর বের হইনি। শুধু নিচে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সারছি। সেদিনের কথা মনে গা শিউরে ওঠে।
সন্ত্রাসীরা ব্যাংক লুটের আগে রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের অস্ত্র গুলি লুট করে নেয়। একই সঙ্গে তাদের জিম্মি করে রাখে। আনসার সদস্য সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এখনো আমরা ভয়ে আছি।’
সেখানে দায়িত্বরত আনসার কমান্ডার মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ঘটনার পর থেকে আনসার সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কনস্টেবল। নাম প্রকাশ না করা শর্তে আজ তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে সশস্ত্র লোকজন এসে আমাদের ওপর যেভাবে হামলা চালাল, ভাবতে গা শিউরে উঠে।...কে কোন দিকে এসে হামলা কিংবা লুটপাট করে বলা মুশকিল।
বান্দরবান সদর থেকে ছেড়ে যাওয়া গাড়িগুলো সড়কের ওয়াই জংশন এলাকায় গিয়ে ভাগ হয়ে যায়। থানচিগামী গাড়িগুলো থানচি সড়কে আর রুমগামী গাড়িগুলো রুমা সড়কে ঢুকে পড়ে। গাড়ির সংখ্যা বেশি হলে ওয়াই জংশনে কিছুটা ভিড় থাকে। আবার অনেক সময় গাড়িতে থাকা লোকজন ও এলাকার দোকান থেকে কেনাকাটা করে। সড়কের পাশে বিভিন্ন পাহাড়ি ফলমূল সড়কের পাশে বিক্রি করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় দোকানি নমিয়া সিং বলেন, আগে যেখানে বিক্রি করে দম ফেলতে পারতাম না। এখন বসে থেকে বেশির ভাগ সময় পার করতে হয়। এভাবে রুমা বান্দরবান সড়কের সদরঘাট, বেথেল হাট, ডাকবাংলো সহ সড়কের ছয়টি বাজারে বেশির ভাগ বিক্রেতাদের অলস সময় পার করতে হচ্ছে।
সদরঘাট এলাকার মুদি দোকানদার মোহাম্মদ হানিফ বলেন, বিক্রি কমে গেছে। এ ছাড়া আগে দোকান বন্ধ করতেন রাত ১১টায়। এখন সন্ধ্যা হলে বন্ধ করে দেন। পাশের চা দোকানের কর্মী দুলাল ধর বলেন, ‘আমরা খুবই ভয়ের মধ্যে আছি। জানি না এই পরিস্থিতি কবে শেষ হবে।’