মধুখালী হত্যা: চেয়ারম্যান তপনকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার ঘোষণা
ফরিদপুরের মধুখালীর পঞ্চপল্লীতে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ মো. আসাদুজ্জামান তপন এবং সদস্য অজিত বিশ্বাসের সম্পৃক্ততার ‘যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে’ বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
তাদেরকে গ্রেপ্তারে সহযোগিতা করলে উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণাও এসেছে। পাশাপাশি এই দুই জনকে আত্মসমর্পণ করে আইনি সুরক্ষা নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। তবে উপযুক্ত পুরস্কার বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তা বলা হয়নি।
শুক্রবার সন্ধ্যায় সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ফরিদপুরের ডিসি কামরুল আহসান তালুকদার এ ঘোষণা দেন। তিনি জানান, তারা এ ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে সময় বাড়িয়েছেন।
চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপন ও অজিত মেম্বার
ডিসি বলেন, “চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপন একজন স্বভাবজাত অপরাধী। কোথায় কখন কীভাবে লুকিয়ে থাকতে হয়, সেটি তিনি ভালো জানেন।
“তিনি আত্মগোপনে যাওয়ার আগে মোবাইল ফোন রেখে গেছেন। এর আগে আমরা মাগুরায় তার অবস্থান শনাক্ত করি। কিন্তু যখন তাকে ধরার জন্য অভিযান চালানো হয়, তখন যশোরে পালিয়ে যান। এরপর যশোরেও তাকে ধরতে অভিযান চালানো হলেও পাওয়া যায়নি।”
স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও উপরে হামলা ও টিসিবির কার্ড নিয়ে দুর্নীতির কারণে তপনকে দুইবার বরখাস্ত করা হয়েছিল জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, “দুই বারই উচ্চ আদালতে আপিল করে তিনি পদ ফিরে পান। এ কারণে তার মধ্যে এক ধরনের বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন, যত অপরাধই করুক না কেন, তিনি পার পেয়ে যাবেন।”
গত ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামের একটি কালী মন্দিরে আগুন লাগার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাশের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থানরত নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর হামলা হয়। স্কুলের টয়লেট নির্মাণের কাজ চলছিল। সেজন্য শ্রমিকরা সেখানে ছিলেন।
সেখানে পিটুনিতে দুই শ্রমিকের প্রাণ যায়। তারা হলেন, উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের ঘোপেরঘাট গ্রামের ২১ বছর বয়সী আশরাফুল ও তার ভাই ১৫ বছর বয়সী আশাদুল। এ ঘটনায় আহত আরও পাঁচ শ্রমিক চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শ্রমিকদের পিটিয়ে হত্যার একটি ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে।
এই ঘটনায় এলাকায় তীব্র ক্ষোভের মধ্যে ঘটনার তদন্তে কমিটি করে জেলা প্রশাসন। এলাকায় বিজিবিও মোতায়েন করা হয়। ২০ এপ্রিল ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান নিহত দুই ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
ধর্মমন্ত্রীর সফরের সময়েও চেয়ারম্যান তপনকে তার সঙ্গে দেখা যাওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডিসি কামরুল বলেন, “তার দ্বৈত ভূমিকার কারণে তাকে সেভাবে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়নি। তবে ভিডিও ফুটেজ প্রকাশের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান।”
আসামিদের গ্রেপ্তারে সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, “তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা সবার সহযোগিতা চাই। কেউ যদি অন্যান্য আসামিদের অবস্থানও জানাতে পারেন, তাহলে তাদের উপযুক্ত পুরস্কার দেয়া হবে।”
গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকার প্রশংসা
পঞ্চপল্লীর ঘটনায় গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রশংসাও করেন ডিসি। বলেন, “সাংবাদিকেরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হতে পারে, এমন একটি নিউজও করে নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ফরিদপুরের সাংবাদিকদের এই আচরণে তাদের প্রশংসা করেছেন।
“ঘটনার পর আমাদের সঙ্গে ওই রাতে ঘটনাস্থলেও থেকেছেন। তারা প্রত্যেকটি জায়গায় উপস্থিত থেকে পুরো বিষয়টি যথাযথভাবে উপস্থাপন করায় এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বিষবাষ্প ছড়ানোর আশঙ্কা ছিল, সেই সুযোগ কেউ পায় নাই।
"এ পর্যন্ত আপনারা যথেষ্ট দ্বায়িত্বশীল আচরণ করেছেন। এটি সমগ্র ফরিদপুরের মর্যাদা রক্ষা করেছে। বাকি দিনগুলো আমরা সবাই মিলে ফরিদপুরে এই সহাবস্থান অব্যাহত রাখতে পারি সে আহ্বান জানাচ্ছি", বলেন তিনি।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার পাঁয়তারা করলে তথ্য দেওয়ার জন্যও অনুরোধ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
কোনো কোনো মহল ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করতে চেষ্টা চালাচ্ছে জানিয়ে ডিসি বলেন, “তারা এটিকে হিন্দুদের হাতে মুসলিম শ্রমিকদের হত্যা হিসেবে উপস্থাপন করছেন। এটি সঠিক নয়। অনেকে নানাভাবে সহায়তা করে তাদের সহানুভূতি কুড়ানোর জন্য ভিডিও করছে এবং সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ঘটনা ভিন্নভাবে প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।”
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর উদ্দেশে ডিসি বলেন, “সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি আমাদেরও। একটি আন্দোলনের ডাক দিলে সেখানে নানা ধরনের লোক ঢুকে যায়। অবরোধের সময়েও একটি মহল সেখানে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে চালানোর চেষ্টা হয়েছে “
পরিবারকে সহায়তা
নিহতদের পরিবারকে ধর্মমন্ত্রী এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর পক্ষ থেকে নগদ আর্থিক সহায়তা করা ছাড়াও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তার তথ্যও তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
ডিসি বলেন, “এ ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা ও তাদের পরিবারকে জীবিকা নির্বাহের জন্য খাদ্য সামগ্রী প্রদান ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তাই এ ঘটনাকে নিয়ে যাতে কোনো মহল বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের অপচেষ্টা চালাতে না পারে সেজন্য সবার সহযোগিতা চাই।”
জেলা প্রশাসনের তদন্তে আরো সাত দিন
ঘটনার পর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (নেজারত) মো. আলী সিদ্দিকীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তারা যথাসময়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে পারেনি।
“এজন্য তারা সময় চেয়েছে। তাদের লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটির মেয়াদ আরো সাতদিন বাড়ানো হয়েছে”, বলেন ডিসি।
এ ঘটনায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত এবং তদন্ত রিপোর্ট না দেয়া পর্যন্ত মধুখালীতে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়ন থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে এ সময় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (নেজারত) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইয়াসিন কবীর, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তামান্না তাসনিম, ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকী সহ জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন।