রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ২৩ ভাদ্র ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ১৩ জুলাই ২০২৪

আপডেট: ১৩:৪০, ১৩ জুলাই ২০২৪

বৃষ্টি হলেই ঢাকা থই থই, কেন এমন দশা, কারণ কি?

বৃষ্টি হলেই ঢাকা থই থই, কেন এমন দশা, কারণ কি?

আষাঢ়ের শেষ সময়ে সাপ্তাহিক ছুটির ভোরে ঝুম বৃষ্টিতে আয়েশি ঘুমের সুযোগ যাদের ছিল না, তারা ঘরের বাইরে বের হয়ে পড়েন থই থই পানিতে। দুপুরের আগে আগে বৃষ্টি থামে, কিন্তু পানি আর নামে না। কিছু এলাকা ১২ ঘণ্টা তলিয়ে থাকে। এই জলাবদ্ধতার জন্য ব্যবস্থাপনায় থাকা দুই সিটির দিকেই তীর ছুড়ছেন নগরবাসী।আবহাওয়া অধিদপ্তর শুক্রবার ঢাকায় ১৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে।

এর আগে ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ১১৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। গত ৯ জুন তিন ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছিল ৮৫ মিলিমিটার। এসময়ও জলজটে পড়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা।

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর ঢাকায় ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছিল ২৫৫ মিলিমিটার। এর আগে ২০০৯ সালে একদিনে সর্বোচ্চ ৩৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে। প্রতিবার এমন জলাবদ্ধতা দেখা গেছে, তবে এবারের চিত্রটা আরও বেশি খারাপ।

দুপুরের আগেই কাকরাইল, মোহাম্মদপুর, শ্যাওড়াপাড়া, কাজীপাড়াসহ মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা এবং মিরপুরে মাজার রোড, এলিফেন্ট রোড, মৎস্যভবন, সেন্ট্রাল রোড, ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে পানি জমে যায়।

কারওয়ান বাজার, ফার্মগেইট, তেজগাঁও, বিজয় সরণি, পশ্চিম তেজতুরী বাজার, তেজকুনি পাড়া, দক্ষিণ মনিপুরের মোল্লাপাড়া, মহাখালীরও বড় এলাকা তলিয়ে ছিল। শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, কাকরাইল, নয়া পল্টন, পুরানা পল্টন, আরামবাগ, শাহজাহানপুর, ফকিরেরপুল, বিজয়নগর সড়কে পানি উঠে যায়।

পানিতে তলিয়ে যায় দয়াগঞ্জ মোড়, সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল, নিমতলী, কমলাপুরের কাছে টয়েনবি সার্কুলার রোড, যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখাড়া, রায়েরবাগ, গোলাপবাগের নিচু এলাকাও।

শুক্রাবাদ পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার রিশাদ মিয়া বিকালে বলেন, “পানি নামার কোনো খবর নাই। কোমর পানিতে চলাচল করতে হচ্ছে।” মহাখালী দক্ষিণ পাড়াতেও বিকালে ছিল কোমরপানি। এই এলাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি বাসা বাড়তেও পানি ঢুকে গেছে।”

মাহবুব জেনারেল স্টোরের মাহবুবুল আলম বলেন, “প্রায় কোমরসমান পানি দোকানে ঢুকেছে।মালামাল সব ভিজে বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়ে গেল আমার।”

শান্তিনগরের ফুটপাত ধরে যাওয়া মিন্টু বলেন, “পানির ঢেউ দেখে মনে হচ্ছে নদীর ঢেউ। বাস যাওয়ার সময় ময়লা পানিতে আমার সব জামা কাপড় ভিজে গেছে।”

কী বলছে দুই সিটি

২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসা থেকে ড্রেনেজ সিস্টেম দুই সিটি করপোরেশনের কাছে দেওয়া হয়। এরপর জলাবদ্ধতা কেন হয়, কোন কোন জায়গায় হয়- তা নিয়ে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার কথা জানানো হয়।

এই দুই বছরে কী কাজ হল- এই প্রশ্নে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ,জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী(পুর) মো. খায়রুল বাকের বলেন, “স্বল্পমেয়াদির মধ্যে রয়েছে, জলাবদ্ধতা হয় ব,সে ১৬১টি স্থান নির্ধারণ করেছি, এর মধ্যে ১০৯টি স্থানে সমাধান করা হয়েছে এবং ২৬টি স্থানে চলমান ও আরও ২৬টি কাজ আগামী অর্থবছরে করা হবে।”

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, “পানি নামতে দিতে হবে। এজন্য নর্দমা লাইন, বক্স কালভার্ট, খাল, নদী পর্যন্ত লাইন তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে।”

যদি স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা এগিয়েই গিয়ে থাকে, তাহলে এমন দুর্ভোগ কেন- এই প্রশ্নে প্রতিবারের মত পলিথিন আর প্লাস্টিকের অসচেতন ব্যবহার আর যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখার প্রবণতার কথাই তুলে ধরেন এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “দিনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে কমলাপুর পাম্পিং স্টেশনে। দেখা গেছে- পানির সঙ্গে ভেসে আসছে কয়েক ট্রাক পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল। এর চেয়ে কতগুণ লাইনে আটকে রয়েছে।

“ম্যানহোলে ডাবের খোসা। যার কারণে ভেতর দিয়ে পানি আসতে দেরি হয়। এসব তো নাগরিকরাই ফেলে। এসব কারণে ভোগান্তি হচ্ছে।”

রাত আটটার দিকেও কমলাপুর স্টেশন, দিলকুশা, আরামবাগ, মতিঝিল ডুবে ছিল। এসব এলাকায় আরো দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যাবে জানিয়েও খায়রুল বাকের তবু অগ্রগতির দাবি করেছেন।

এই প্রকৌশলী বলেন, “বছর তিন-পাঁচেক আগে দুই থেকে চার দিন পানি আটকে থাকত। এখন দুই ঘণ্টা হলেই অতিষ্ঠ হয়ে যাই। তবে সচেতন হলে আরও ভালো হত।

“ড্রেনেজ সিস্টেমে যদি এসব আবর্জনা না ফেললে এ দুর্ভোগ হত না। লেপ, তোশক, জাজিম পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে ড্রেনেজ সিস্টেমে। এ রকম অসচেতন হলে পানি যাবে কোন দিক দিয়ে?”

খালগুলো পরিষ্কার করে সীমানা নির্ধারণ শেষে দুই পাশে সাইকেল লেন, ওয়াকওয়ে, ব্রিজ তৈরি করে দৃষ্টিনন্দন করার পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে খায়রুল বাকের বলেন, “আদি বুড়িগঙ্গার ৪ লাখ ৫০ হাজার টন ময়লা পরিষ্কার করা হয়েছে। সেদিকে আর জলাবদ্ধতা হয় না।

“এখন চারটা খাল নিয়ে প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। ৩৯টি ছোটবড় খাল রয়েছে। ধীরে ধীরে বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে করা হবে।  সীমানা নির্ধারণ করা হচ্ছে সিএস অনুসারে। এটা হলে পুরোদমে কাজ শুরু করব। ২০২৪ সালের মধ্যে দৃশ্যমান হবে আশা করি।”

উত্তর সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ বলেন, “মহাখালী খাল দিয়ে ধীরে ধীরে পানি নামছে। নতুন ১৮টি এলাকায়ও দুর্ভোগ হয়েছে।

“কাজীপাড়া-শেওড়া পাড়ার দিকে যে খালটি রয়েছে তার ধারণক্ষমতা কমে গেছে, তাতে পানি দ্রুত নামেনি।” ওই খালের পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “পাশাপাশি বিকল্পভাবে এ পানি অন্যদিকে আনা যায় কিনা তাও চিন্তা করা হচ্ছে।”

এই কর্মকর্তাও যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখার প্রবণতার কথা তুলে ধরেন। বলেন, “যে যার মত খালে ময়লা ফেলছে, খালগুলোর নিচে পলিথিন জমে গেছে।” খালগুলোকে উদ্ধারের বিষয়ে একটি মহাপরিকল্পনা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সীমানা চিহ্নিতকরণে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে টেকনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (টিএপিপি) পাঠানো হয়েছে এবং এটা পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে অনুমোদন হয়ে যাবে বলে আশা করছে ঢাকা উত্তর সিটি।

ঘাটতি কোথায়

কাজলার হালটপাড় এলাকা নিবাসী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “এখানকার খাল দিন দিন সরু হচ্ছে দখলদারদের কারণে। পানি যে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়বে তা বাধা পায় জায়গায় জায়গায়। আমরা নিম্নাঞ্চলের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের তালিকায় সবার নিম্নে আছি। তাই জনগণের দুর্ভোগ নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ।”

খাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসা থেকে সিটি আসার সাড়ে তিন বছরেও জনবল কাঠামোই তৈরি করতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।

“মন্ত্রণালয় পারমিশন দিয়েছে। ১৭৫ জনের জন্য অর্গানোগ্রাম করা হয়েছে, আরও অপেক্ষা করতে হবে” বলেন ঢাকা উত্তরের কর্মকর্তা ফারুক হাসান।

খালের সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে আমাদের অধীনে থাকা ২৯টি খালের সীমানা চিহ্নিতকরণ শেষ হবে।”

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “এত বছর ধরে আমরা যা-যা বলে এসেছি, সেই কারণগুলোর একটারও প্রতিকার হয়নি বলেই আবার এই অবস্থাটা হল। এই অবস্থা আরও প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে।”

তার মতে, সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় ৪০ থেকে ৪৩ শতাংশ বর্জ্য সিটি করপোরেশন সংগ্রহই করতে পারে না। আর এসব বর্জ্য যায় নালা ও খালে।

তিনি বলেন, “বৃষ্টি হওয়ার পর ঢাকার বিভিন্ন সারফেস ড্রেনের মাধ্যমে পানি মূল ড্রেনে যায়। তার মধ্যে কতগুলো লেক বা খাল অথবা পুকুরের মধ্যে পানি যায়। ধীরে-ধীরে ঢাকার পশ্চিম ও পূর্ব দিকে নদীতে চলে যায়।

“এই পুরো ব্যবস্থা যদি বিঘ্নিত হয়, যদি কালভার্ট-বক্স কালভার্ট বানান অথবা ময়লা জমিয়ে খাল বন্ধ করে ফেলেন, পুকুরগুলো ভরাট করেন, যদি জলাশয়গুলো যদি উদ্ধার করে ধরে রাখতে না পারেন, তবে এই পরিণতি অবশ্যম্ভাবী।”

তার মতে, সিটি করপোরেশন যথাযথ মহাপরিকল্পনা নেই, নেই আছে প্রয়োজনীয় লোকবল, নেই অর্থের জোগান। এরই ফলাফল এই জলাবদ্ধতা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “আমাদের ঢাকা শহরে খাল বা জলাশয় এখন ৫ শতাংশের নিচে, সবুজ এলাকা ৭ শতাংশের কম, ফলে পানি নিষ্কাশনের সুযোগ নেই। যদি জলাশয় ভরাট করা না হত এবং পর্যাপ্ত সবুজ থাকত, তাহলে হয়ত এমন চিত্র হত না।”

ঢাকার উন্নত এলাকাগুলোতে কোথাও ৮০ শতাংশ, কোথাও ৯০ শতাংশ কংক্রিট আচ্ছাদিত জানিয়ে তিনি বলেন, “ফলে পানি নিষ্কাশনের সুযোগ নেই। এই জলাবদ্ধতা মেনে নিতেই হবে।”উন্নতির কি কোনো সুযোগ নেই?- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “ড্রেনেজ সিস্টেম এবং জলাশয় অবশিষ্ট আছে, সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে জলাশয় ভরাট করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”
 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়