মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ১ আশ্বিন ১৪৩১

ফেনী প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ২৮ আগস্ট ২০২৪

আপডেট: ১৪:২৪, ২৮ আগস্ট ২০২৪

বিদ্যুৎবিহীন ফেনীতে মোমের আলোয় ডেলিভারি, সাপেকাটা রোগীর হিড়িক

বিদ্যুৎবিহীন ফেনীতে মোমের আলোয় ডেলিভারি, সাপেকাটা রোগীর হিড়িক

ফেনী জেনারেল হাসপাতালের পুরানো ভবনের দ্বিতীয় তলার প্রসব ওয়ার্ডের অপারেশন থিয়েটারে চলছে এক প্রসূতির প্রসবের প্রস্তুতি। মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একজন নার্স। আরেকজন নার্স রোগীর স্বাভাবিক প্রসবের কাজ করছেন। বিদ্যুৎ না থাকায় মোমবাতির আলোতেই পৃথিবীর আলো দেখে পূজা রানী দাসের সন্তান।

শহরের সহদেবপুর এলাকার বাসিন্দা শিমুল চন্দ্র দাসের স্ত্রী পূজা রানী এমন এক সময় নবজাতকের মা হলেন-যখন স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী।

জেলার চারদিকে কেবল থইথই পানি। বানের জলে ভাসছে ঘরবাড়ি। জীবন বাঁচাতে আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে মানুষ। প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেটবিহীন সময়টাতে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না অনেকেই।

এ পরিস্থিতিতে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে গত সাত দিন ধরে মোমবাতি বা মোবাইল টর্চের আলোয় প্রসব ও সেলাইয়ের কাজ করা হচ্ছে, বললেন হাসপাতালের একজন নার্স।

পূজা রানীকে জেনারেল ওয়ার্ডে স্থানান্তরের পর জানা গেল, স্বামী ও স্বজনরা প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম বাইরে থেকে কিনে এনেছিলেন। হাসপাতাল থেকে তারা কোনো ধরনের সহায়তা পাননি।

মঙ্গলবার দুপুরে জেলার সবচেয়ে বড় এ হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, বন্যার সময়ে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত পানি ও ওষুধ। পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন পুরানো ভবনের দোতলার মেঝেতে। পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেয়ে অনেক রোগী ফিরেও যাচ্ছেন।

প্রসব ওয়ার্ডে কথা হয় সদর উপজেলার কাজিরবাগ গিল্লাবাড়িয়া থেকে আসা বিবি হাজিরার সঙ্গে। বলছিলেন, বন্যা শুরুর দিন ২১ অগাস্ট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে গত সাতদিনেও তার ডিঅ্যান্ডসি (গর্ভপাত বা গর্ভাবস্থার পরে রক্তপাতের চিকিত্সা; প্রথম ত্রৈমাসিকের গর্ভপাতের জন্য-গর্ভাবস্থার অবসান) হয়নি। কবে তার ডিঅ্যান্ডসি হবে তাও নার্সরা ঠিকভাবে জানাতে পারেননি।

একই ওয়ার্ডে ঢুকতে দরজার সঙ্গে লাগোয়া সিটে বসে থাকতে দেখা গেল প্রসূতি রোকসানা আক্তারকে। সদর উপজেলার ধলিয়া থেকে প্রসব বেদনা নিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছেন।

কিন্তু লেবার ওয়ার্ডে বিদ্যুৎ না থাকায় গরম ও উটকো গন্ধে দম বন্ধের উপক্রম হয়েছে বলে জানান রোকসানা। দুদিন ভর্তি থাকলেও হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়নি কোনো খাবার।

এসব বিষয়ে জানতে হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নুরজাহান বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “২১ অগাস্ট রাত থেকে হাসপাতালে বিদ্যুৎ নেই। অন্যসব ওয়ার্ডে মঙ্গলবার থেকে বিদ্যুৎ সরবাহ করা হলেও লেবার ওয়ার্ডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়নি।

“সাতদিন ধরে মোমবাতি কিংবা মোবাইল টর্চের আলোয় ডেলিভারি ও সেলাই কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ডেলিভারি শেষে হাত ধোয়ারও পানিটুকু পর্যন্ত পাইনি। তবুও আমরা সেবা চলমান রেখেছি।”

সেলিনা আক্তার নামের আরেক সিনিয়র নার্স বলেন, “বিদ্যুৎ না থাকায় অটোক্লেপ মেশিন কাজ করছে না। গত সাত দিনে দুই সিজারিয়ান প্রসূতিকে জরুরি ভিত্তিতে বন্যা ডেডিকেটেড ‘আল আকসা’ ও ‘মিশন’ হাসপাতাল পাঠিয়ে ফ্রি সিজার করানোর ব্যবস্থা করেছি।”

সিনিয়র নার্স মর্জিনা আক্তার বলছিলেন, ২১ আগস্ট বুধবার সকালে বন্যা শুরু হলে রাতে হাসপাতালে পানি ঢুকে। পরদিন ২২ অগাস্ট সকালে কোমর সমান পানি থাকায় হাসপাতালে যেতে সড়কে দায়িত্বরতদের একাধিকবার অনুরোধ করার পরও তারা আমাদের পরিবহন সহায়তা করেনি।

তিনি বলেন, “আমাদের সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। প্রতিদিন পানিতে ভিজে হাসপাতালে আমরা দায়িত্ব পালন করেছি। বন্যার মধ্যে গত ছয় দিনে লেবার ওয়ার্ডে ২৮টি সফল ডেলিভারি হয়েছে।”

লেবার ওয়ার্ড ঘুরে হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গিয়ে সুনশান নিরবতা দেখা গেল। বন্যার পানিতে ওয়ার্ডটি তলিয়ে গেলে ২১ অগাস্ট রাতেই রোগীদের দ্রুত পুরোনো ভবনের দোতলার বারান্দায় স্থানান্তর করা হয়।

ওই ওয়ার্ডের সিনিয়র নার্স পাখি রানি দাস বলেন, “ওইদিন রাতেই ভর্তি থাকা ২৩ রোগীকে নির্ধারিত ওয়ার্ড থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়। বন্যার পানিতে ডায়রিয়া ওয়ার্ডের বেহলা দশা। ভিজে নষ্ট হয়েছে বিছানাসহ সব সরঞ্জাম। ওয়ার্ডটি আগের স্থানে ফেরাতে অন্তত সপ্তাহখানেক সময় লাগতে পারে।”

দোতলার মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১০ মাস বয়সী শ্রাবণ দেবনাথ। তার মা মিতা দেবনাথ বলেন, “ছেলেকে নিয়ে সোমবার রাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। বেড না পেয়ে মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছি। মঙ্গলবার সকালে এক চিকিৎসক এসে মাত্র এক মিনিট রোগীকে দেখে ওষুধ লিখে চলে যান। হাসপাতাল থেকে না পেয়েছি স্যালাইন, না পেয়েছি কোনো ওষুধ। সব বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।”

হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডেও একই চিত্র। বেডের পাশাপাশি মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন বিপুল সংখ্যক রোগী। আড়াই মাস বয়সী আফিফা রহমান ভর্তি হয়েছেন জ্বর ও বমি নিয়ে।

শহরের একাডেমি থেকে আসা রোগীর স্বজন আনিসুল হক বলেন, “রোববার এক চিকিৎসক রোগীকে দেখে ওষুধ দিলেও সোমবার কোনো চিকিৎসক আসেননি। মঙ্গলবার সকালে এক চিকিৎসক এলেও ভালো করে রোগীকে দেখেননি।”

আরেক অভিভাবক পেশায় শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বন্যার কারণে হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগ বন্ধ থাকায় মিলছে না কোনো ধরনের পরীক্ষা। ওয়ার্ডের বাথরুমের অবস্থা শোচনীয়। বন্যার কারণে শৌচাগার পরিষ্কার না করায় কোনো সুস্থ মানুষ বাথরুমে গেলে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।”

দুপুর ১২টায় চিকিৎসকদের নির্ধারিত কক্ষের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা।

নিচতলায় বন্যার পানি ঢোকায় ডায়ালায়সিস ওয়ার্ডে সব মেশিন ২১ অগাস্ট রাতেই সরিয়ে দোতালার বারান্দায় রাখা হয়। জরুরি বিভাগে টানা চার দিন পানি থাকায় ওই ওয়ার্ডেরও সেবা চলছে দোতলার চিকিৎকদের চেম্বার সংলগ্ন রোগীদের অপেক্ষার কক্ষে।

চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরতে রিকশাভ্যানে চড়েছেন রোগী নাহিদা আক্তার। তিনি বলছিলেন, ছাগলনাইয়া উপজেলার কন্ট্রাক্টর মসজিদ এলাকা থেকে এসে ২০ অগাস্ট তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। নবজাতকের জন্ডিস ধরা পড়ায় হাসপাতালে ভর্তি হলেও পরদিন সকালে চিকিৎসক দেখে ওষুধ লিখে দেন।

তিনি বলেন, “এরপর আর কোনো চিকিৎসক বা সেবা মেলেনি। এক সপ্তাহ পর আজ সকালে আরেক চিকিৎসক এসে আমাদের রিলিজ করে দেন। নবজাতককে নিয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছি।”

এসব বিষয়ে জানতে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবুল খায়ের মিয়াজির সঙ্গে কথা বলতে গেলে তার কক্ষে তালা ঝুলতে দেখা যায়। কক্ষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিয়ন বলেন, “স্যারের জ্বর। তিনি অসুস্থ্ থাকায় অফিসে আসেননি।”

এর কিছুক্ষণ পর জানা গেল তত্ত্বাবধায়ক আবুল খায়ের মিয়াজি পাশের আরেকটি কক্ষে (৬০৫ নম্বর) শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ সময় হাসপাতালের অন্যসব চিকিৎসকরা তার সঙ্গে দেখা করতে ওই কক্ষে প্রবেশ করেন।

রোগীদের অভিযোগ ও হাসপাতালের বর্তমান অবস্থা জানতে কথা হয় আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আসিফ ইকবালের সঙ্গে।

তিনি বলেন, বন্যায় হাসপাতালের নিচতলা ডুবে থাকলেও কখনও এক মিনিটের জন্য বন্ধ ছিল না চিকিৎসা সেবা। সার্বক্ষণিক খোলা ছিল জরুরি বিভাগ। সোমবারও জরুরি বিভাগে ২২৭ জন রোগীকে দেখেছেন চিকিৎসকরা। এদের মধ্যে ১১৫ জন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

হাসপাতালে খাবার পানির সংকট রয়েছে। তবে লেবার ওয়ার্ডে দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করতে কাজ চলছে। পাশাপাশি বন্যার কারণে বন্ধ থাকা আল্টাসনোগ্রাফিসহ প্যাথলজি বিভাগ দ্রুত সময়ের মধ্যে চালু করতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

আসিফ বলেন, “বন্যার সময়ে নিরবচ্ছিন্ন সেবা কার্যক্রম চালাতে গত কয়েকদিন আগে জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের ছয়টি বন্যা ডেডিকেটেড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তবে পানি নেমে যাওয়ায় মঙ্গলবার থেকে বন্যা ডেডিকেটেড ওইসব হাসপাতালে সাময়িক পদায়নরত চিকিৎসকদের ফের জেনারেল হাসপাতালে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

“আজও বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অনুদানের ত্রাণ সামগ্রী গ্রহণ করা হয়েছে, যা রোগীদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।”

আরএমও অভিযোগ করে বলেন, “বন্যার মধ্যে পানি ডিঙ্গিয়ে নিয়মিত হাসপাতালে এসেছি। আমিসহ চিকিৎসকের পরিবহন সহায়তা দিতে নির্ধারিত জরুরি নম্বরে বলার পরও তাদের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বন্যায় পানিতে ভেসে যাওয়া দুটি লাশ এলে সেটিও গ্রহণ করে মর্গে রাখা হয়েছিল। তারপরও যদি কেউ বলে আমরা কাজ করছি না তাহলে আর কি করতে পারি?”

বেড়েছে সাপেকাটা রোগী

হাসপাতালে ২১ অগাস্ট থেকে সাপেকাটা রোগীর হিড়িক পড়েছে। এই সময়ের মধ্যে ৪২ জন পুরুষ ও ১৩ জন নারী সাপেকাটার জন্য চিকিৎসা নিয়েছেন।

দুপুরে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছেন সাপেকাটা রোগী শওকত আকবর। সদর উপজেলার লেমুয়া ইউনিয়নের মীরগঞ্জ গ্রামে তাকে সাপে কামড় দেয়। দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে চিকিৎসা সেবা পান শওকত আকবর।

জরুরি বিভাগের সিনিয়র নার্স সুচিতা রানী বণিক বলেন, “বন্যার পানির কারণে বেড়েছে সাপেকাটা রোগীর সংখ্যা। প্রতিদিনই গড়ে সাত থেকে আটজন সাপেকাটা রোগী জরুরি বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। সব রোগীর প্রতিষেধক টিকা অ্যান্টিভেনম প্রয়োজন পড়ছে না। যাদের প্রয়োজন পড়ছে তাদের এ টিকা দেওয়া হচ্ছে। হাসপতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেমন মজুদ রয়েছে।”

সর্বশেষ

জনপ্রিয়