মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ১ আশ্বিন ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ৩০ আগস্ট ২০২৪

আপডেট: ০৯:২৩, ৩০ আগস্ট ২০২৪

উঁচু এলাকার লোক ত্রাণ পাচ্ছেন বেশি, দূরে যাচ্ছে না নৌকার অভাবে

উঁচু এলাকার লোক ত্রাণ পাচ্ছেন বেশি, দূরে যাচ্ছে না নৌকার অভাবে

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার রায়কোট উত্তর ইউনিয়নের পিপড্ডা গ্রামের বাসিন্দা আরিফুর রহমান মজুমদার একজন শতবর্ষী মানুষ। নিজেই হাঁটাচলা করে মসজিদে যেতে পারেন; বাড়িতে সাংসারিক বিভিন্ন কাজও সামলান।

ভারত থেকে হু হু করে নেমে আসা পানি ও কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ভয়াবহ বন্যায় শতবর্ষী এই বৃদ্ধের বাড়িও তলিয়ে গেছে। দীর্ঘ এই জীবনে নিচের চোখে কখনও এত পানি দেখেননি বলে জানান তিনি। এছাড়া বানভাসিদের ত্রাণ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই বৃদ্ধ।

আরিফুর বলেন, “আমার বয়স এখন প্রায় ১১০ বছর। আমার এই জীবনে এত বড় বন্যা, এত পানি দেখিনি। কোথা থেকে এল এই পানি সেটাই ভেবে কূল পাচ্ছি না। আমার বাবার কাছেও কখনও শুনিনি এমন বন্যার কথা। মানুষের বাড়িঘর পানির নিচে। ডুবে গেছে সব সড়কপথ।

“বানভাসি মানুষের কষ্ট দেখে নিজের কাছে খারাপ লাগে। আরও কষ্ট লাগে যখন দেখি যারা বন্যাদুর্গত, যারা কষ্টে আছেন- তারাই ত্রাণ সহায়তা পায় না। বিশেষ করে যাদের বাড়ি বিভিন্ন সড়কের মুখপাতে এবং ডাঙার মধ্যে- তারাই ত্রাণ বেশি পাচ্ছে। কিন্তু নদী ও খালের পাড়ে যেসব মানুষের বাড়ি, তাদের খোঁজও কেউ নিচ্ছে না। আমি অনুরোধ করবো যারা ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছেন- যারা যেন সমবণ্টন করেন।”

এ ধরনের অভিযোগ যে শুধু আরিফুর একাই করেছেন তা না; বরং প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক বন্যার্ত মানুষের এই অভিযোগ আছে।

তারা বলছেন, কুমিল্লার বাইরে থেকে যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন তাদের অনেকেই ট্রাকে করে আসছেন। কিন্তু বন্যার্তদের কাছে পৌঁছার সব রাস্তাঘাটে পানি। কোথাও কোথাও আবার রাস্তাঘাট ভেঙেও গেছে।

ফলে বন্যার্তদের কাছে পৌঁছাতে হলে নৌকা বা স্পিডবোট প্রয়োজন- যা এখন খুবই অপ্রতুল। ফলে ডাঙ্গার কাছাকাছি থাকা লোকজনের হাতে ত্রাণ পৌঁছাছে বেশি।

অপরদিকে ত্রাণ এলেই সড়কের আশপাশের মানুষ ভিড় করে গাড়ি আটকে দিচ্ছে। তারা বারবার ত্রাণ পাচ্ছে। ত্রাণ না পেলে গাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বৃহস্পতিবার গোমতী নদী পাড়ের বিভিন্ন এলাকার পানিবন্দি মানুষ এসব অভিযোগ করেন।

গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়া এবং সালদা ও ঘুংঘুর নদীর ভাঙনের কারণে কার্যত পানির ওপর ভাসছে বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ত্রাণ সহায়তা আসছে বুড়িচং উপজেলার জন্য।

এসব ত্রাণের গাড়ি কুমিল্লা শহরতলীর শাসনগাছা থেকে পালপাড়া ব্রিজ হয়ে কালখাড়পাড় এলাকা দিয়ে বুড়িচংয়ে প্রবেশ করে। কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন বস্তি থেকে আসা লোকজন এ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। বন্যাদুর্গত নয়, এমন এলাকার লোকজনও ভিড় করছে এই পথটিতে।

ত্রাণের গাড়ি এলেই সেটিকে জটলা বেঁধে ঘিরে ধরা হচ্ছে। যার কারণে ত্রাণবাহী গাড়িগুলো ঠিকভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে না। কিছু গাড়ি ভিড় ঠেলে একটু সামনে অগ্রসর হলেও অনেক সময় নৌকার অভাবে গন্তব্যে খাবার পৌঁছে দিতে পারছে না।

বুড়িচং প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক বাবুর ভাষ্য, “যাদের ত্রাণ দরকার তারা পাচ্ছেন না; অথচ যারা পাচ্ছেন তারা একাধিকবারও পাচ্ছেন। বন্যার শুরু থেকেই সব জায়গায় শৃঙ্খলার অভাব দেখছি আমরা।

“ত্রাণের গাড়িগুলো কুমিল্লা শহর হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতেই একদল লোক সেটিকে ঘিরে ফেলে; যাদের প্রায় সবাই ডাঙার মানুষ। কৌশলে বন্যার্তদের ত্রাণে ভাগ বসাচ্ছে তারা। সড়কে প্রশাসনের সরব উপস্থিতি ও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকলে যে পরিমাণ ত্রাণ আসছে, তা দিয়ে দুর্গত এলাকায় কয়েকদিন চলে যেত। মানুষের মধ্যে এমন হাহাকার থাকতো না।”

এ ধরনের প্রবণতার কথা স্বীকার করেছেন বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার।

তিনি বলেন, “আমাদের পুরো উপজেলা এখনো পানির উপর ভাসছে। প্রতিনিয়ত পানির মাত্রা বাড়ছে। ইউনিয়ন পরিষদের সচিবদের দিয়ে দুর্গম এলাকায় খাবার পৌঁছানো হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি সমভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে।

“এরই মধ্যে একাধিক স্থানে ত্রাণের গাড়িতে হামলা হয়েছে। সেনাবাহিনী মাঠে কাজ করছে। তবে যে পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা দরকার, তা পাওয়া যাচ্ছে না। এসব বিষয়ে আমরা কাজ করছি।”

ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইশ এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসাইন বলেন, “এ উপজেলার শতভাগ গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এখানে পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছেন না বানভাসিরা। যা ত্রাণ আসছে তা রাস্তার মুখপাতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ অনেক কষ্টে আছেন। রয়েছে বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট।”

ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স ম আজহারুল ইসলাম বলেন, “এরই মধ্যে এই উপজেলার জন্য আসা সরকারি বরাদ্দের টাকা প্রায় শেষ। বুড়িচং হয়ে এখানে ত্রাণ পৌঁছানো বর্তমানে সম্ভব না। কারণ পানি অনেক বেশি, সব সড়কপথ পানিতে ভাসছে।

“এ উপজেলার জন্য যারা ত্রাণ কাজে সহায়তা করতে চান, তারা মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ হয়ে ব্রাহ্মণপাড়ায় ঢুকতে পারবেন। সেভাবে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে আসার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।”

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, কয়েকটি স্থানে পানি কমলেও কুমিল্লার বন্যা পরিস্থিতির এখনো উন্নতি হয়নি। ১৭ উপজেলার মধ্যে ১৪টিতেই ভয়াবহ রূপ দেখাচ্ছে আকস্মিক এই বন্যা। ১৪ উপজেলায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ।

তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, এ সংখ্যা আরও কয়েক লাখ বেশি হবে।

এদিকে ডাকাতিয়া নদীর পাড় ঘেঁষা নাঙ্গলকোট উপজেলার বাঙ্গড্ডা, রায়কোট উত্তর, রায়কোট দক্ষিণ, মৌকরা, ঢালুয়া, সাতবাড়িয়া, বক্সগঞ্জ ইউনিয়নের গ্রামগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় এসব এলাকার বানভাসি মানুষজন ত্রাণ সহায়তা একেবারেই কম পাচ্ছেন।

রায়কোট উত্তর এলাকায় বসবাসরত আমির হোসেন বলেন, “আমি একাই বাড়িতে আছি। পরিবারের সদস্যদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিসি। বলতে গেলে না খেয়েই বাড়িতে থাকছি। সহায়তা যাচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্র ও রাস্তাকেন্দ্রিক লোকজনের কাছে।”

নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুরাইয়া আক্তার লাকী জানান, এ উপজেলা পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দোতলা-তিনতলা ভবনগুলো আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন সব বানভাসিদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার।

মনোহরগঞ্জ উপজেলার শরীফপুর, বাগচাতল, বুরপৃষ্ট, চিলুয়া, সরসপুর, উত্তর হাওলা, মড়হ, গাজিয়াপাড়া, শাকতলা, কেয়ারিসহ বিভিন্ন স্থানে বন্যার্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের এখানেও ত্রাণ অপ্রতুল।

চিলুয়া এলাকার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, “প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি। এদিকে ত্রাণের জন্য হাহাকার। কিন্তু মানুষ কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। মানুষ কষ্টে আছেন। জানতে পেরেছি যা কিছু ত্রাণ আসছে, সেগুলো সড়ককেন্দ্রিক মানুষ নিয়ে যাচ্ছে।”

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু মুশফিকুর রহমান বলেন, “বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোর দুর্গত এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে শুকনা খাবার, স্যালাইন ও ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণও অব্যাহত আছে।

“আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছি। যারা আটকে পড়েছেন তাদেরকে উদ্ধারে কাজ চলছে। দুর্গম এলাকার সবাই যেন খাদ্য সহায়তা পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে।”

সর্বশেষ

জনপ্রিয়