মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ১ আশ্বিন ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রকাশিত: ১০:১৫, ৩০ আগস্ট ২০২৪

আপডেট: ২২:৫৫, ৩০ আগস্ট ২০২৪

কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল: পরিবেশ উপদেষ্টা বিধানটি সম্পূর্ণ বাতিল হচ্ছে না: এনবিআর

কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল: পরিবেশ উপদেষ্টা  বিধানটি সম্পূর্ণ বাতিল হচ্ছে না: এনবিআর

কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, কালো টাকা সাদা করার বিধানটি সম্পূর্ণ বাতিল হচ্ছে না। সিকিউরিটিজ, নগদ টাকা, ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট এবং সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিট অপ্রদর্শিত থাকলে ১৫ শতাংশ আয়কর দিয়ে বৈধ করার বিধান ছিল। বর্তমানে এই বিতর্কিত সুবিধাটি বাতিল করা হচ্ছে। তবে স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমি আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত থাকলে তা নির্ধারিত হারে আয়কর দিয়ে বৈধ করার বিধানটি বহাল থাকছে। 

জানা যায়, বাজেট ঘোষণার সময় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার রীতি বেশ পুরনো। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সেই বিধি ও রীতি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বৈঠক শেষে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এখান থেকে সরকার যে টাকা আনতে পারে, সে টাকা দিয়ে যে সরকারের খুব বেশি কিছু এগোয় তা নয়। বরং মূল্যবোধটার অবক্ষয় ঘটে। অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে বলেও জানান এই উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আনতে যা যা করা দরকার, সরকার সেটা শুরু করেছে। এ ছাড়া হজ প্যাকেজের বাড়তি খরচ কমানো সম্ভব উল্লেখ করে সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ১৫ শতাংশ আয়কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিধান বহাল রাখা হয়েছিল। এতে সমালোচনা হলেও কোনো পরিবর্তন আনেনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান জোরালো করতে অন্তর্বর্তী সরকার এই বিধান বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শিগগিরই এসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার কথা রয়েছে। এখন শুধু অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের অনুমোদনের অপেক্ষা। তবে এর আগে গত মঙ্গলবার এনবিআর ভবনে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান এবং সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ‘কালো টাকা সাদা’ ইস্যুতে এক প্রশ্নের জবাবে অপেক্ষা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন উপদেষ্টা।

তার দুই দিন পরই এলো সরকারি সিদ্ধান্ত। ১৫ শতাংশ আয়কর দিয়ে অপ্রদর্শিত সিকিউরিটিজ, নগদ টাকা, ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট এবং সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিট বৈধ করা না গেলেও বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিয়ে জমি বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে আগের নিয়ম বহাল থাকছে।

নিয়ম অনুযায়ী স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেসের ক্ষেত্রে মৌজাভেদে প্রতি বর্গমিটারে ৫০০ থেকে ছয় হাজার টাকা আয়কর দিয়ে তা বৈধ করা যাবে। এ ছাড়া ভূমির ক্ষেত্রে মৌজাভেদে প্রতি বর্গমিটারে ৩০০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয়কর দিলে তা বৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ পরিসম্পদ অর্জনের উৎস বিষয়ে আয়কর আইন ২০২৩ বা অন্য কোনো আইনে যা কিছু থাকুক না কেন, আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যক্তিকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না, যদি সেই ব্যক্তি ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন বা সংশোধিত রিটার্ন দাখিল করেন।

তবে কর ফাঁকির কার্যধারা চলমান থাকলে কিংবা যেকোনো আইনের অধীন ফৌজদারি মামলার কার্যধারা চলমান থাকলে এই নিয়মে কর পরিশোধ করা যাবে না।

মূলত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বা অর্থ সাদা করার পরও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে কোনো বাধা না থাকার প্রভাব পড়ে কালো টাকা সাদা করায়। সর্বশেষ ২০২৩-২৪, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেউ কালো টাকা সাদা করেনি। তবে এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করেন দুই হাজার ৩১১ জন। অর্থের পরিমাণে তা এক হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা।

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বর্গমিটারপ্রতি নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে প্লট-ফ্ল্যাট প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তখন ১১ হাজার ৮৫৯ জন করদাতা কালো টাকা সাদা করেন। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন ২৮৬ জন, জমিতে এক হাজার ৬৪৫ জন, ফ্ল্যাটে দুই হাজার ৮৭৩ জন এবং নগদ অর্থ প্রদর্শন করেছেন সাত হাজার ৫৫ জন।

কালো টাকার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবেই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। মূলত কালো টাকাকে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে এই সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা সাদা করা হয়েছে। সেখান থেকে তৎকালীন সময়ে সরকার মাত্র ১৯ লাখ টাকা আয়কর পায়।

পরে এই সুবিধা বহাল থাকায় প্রতিবছরই কালো টাকা সাদা করার অঙ্ক বাড়তে থাকে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা করা হয়, সরকার আয়কর পায় ৮১ লাখ টাকা। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা সাদা হয়, সরকার আয়কর পায় চার কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা সাদা করা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা। এরপর ধারাবাহিকভাবে কালো টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকে। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এক লাফে ৯৫০ কোটি টাকা সাদা করা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৪১ কোটি টাকা।

পরের সাত বছর অর্থাৎ ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৮২৭ কোটি টাকা, ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকা, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৮০৫ কোটি টাকা এবং ২০১৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা মূল ধারার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এ থেকে সরকার রাজস্ব পায় যথাক্রমে ১০২ কোটি, ৯১১ কোটি, ২৩০ কোটি ও এক হাজার ৭৩ কোটি টাকা।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের মোট ৫০টি দেশে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো এমন ব্যবস্থা করেনি কোনো দেশ। ওই সব দেশে সীমিত সময়ের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এবং সুযোগ না নিলে শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে বারবার সুযোগ দেওয়ায় কালো টাকার মালিকরা মনে করেন, ভবিষ্যতেও এই সুযোগ পাওয়া যাবে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়