মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ১ আশ্বিন ১৪৩১

চট্টগ্রাম ব্যুরো

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১২:২৭, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

চট্টগ্রামে শিক্ষার্থী নিপীড়ন মামলার আবেদনে ২৮ সাংবাদিক আসামি

চট্টগ্রামে শিক্ষার্থী নিপীড়ন মামলার আবেদনে ২৮ সাংবাদিক আসামি

আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রীসহ ৪৯ জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের আদালতে একটি মামলার আবেদন করেছেন এক নারী; যাদের তিনি আসামি করেছেন, তাদের ২৮ জনই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক।

মোট ১০ ধরনের অভিযোগ বাদী করেছেন,যার মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের অপহরণ-নির্যাতনের মত অভিযোগও রয়েছে।

বুধবার চট্টগ্রামের মহানগর হাকিম জুয়েল দেবের আদালতে মামলাটির আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে বিচারক অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন।

মামলার বাদী হাসিনা মমতাজ (৫৫) নগরীর কোতোয়ালি থানার নজির আহমদ চৌধুরী রোড বাই লেইন চেয়ারম্যান গলির বাসিন্দা সৈয়দ আবুল হাসেমের মেয়ে। সৈয়দ আবুল হাসেম চট্টগ্রাম নগর বিএনপির নেতা ছিলেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, হাসিনা মমতাজ চট্টগ্রামের মোহরা ছায়েরা খাতুন কাদেরিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল।

তবে সংবাদমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন অনুসারে হাসিনা মমতাজ প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত মাসে অধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

দীর্ঘদিন ধরে অধ্যক্ষের পদ ‘দখলে রাখা’, অর্থ ‘আত্মসাৎ’, ক্ষমতার ‘অপব্যবহার’সহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে আন্দোলনে নেমেছিল ছাত্রীরা।

বুধবার যে মামলার আবেদন তিনি করেছেন, সেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত এবং নগর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মহিউদ্দিনসহ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কাউন্সিলর এবং যুবলীগ-ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাসহ মোট ৪৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।

আদালতের বেঞ্চ সহকারী নূর ই খোদা বলেন, “মামলার আবেদন আজ আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। এরপর আদালত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন।

“পিবিআইয়েল প্রতিবেদন আসার পর মামলাটি গ্রহণ করা হবে কিনা সে বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন।”

যে ২৮ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, তারা হলেন- দৈনিক আজাদীর শুকলাল দাশ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, সময় টিভির কমল দে, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের অনুপম শীল, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি তপন চক্রবর্তী, বিএফইউজের যুগম্ম মহাসচিব কাজী মহসিন, বিএফইউজের নেতা আজহার মাহমুদ, সাংবাদিক রতন কান্তি দেবাশীষ, উজ্জ্বল কান্তি ধর, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মিন্টু চৌধুরী ও উত্তম সেনগুপ্ত, রমেন দাশগুপ্ত, সমকালের মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন, একরামুল হক বুলবুল, দৈনিক আজাদীর ঋত্বিক নয়ন, দৈনিক পূর্বদেশের রাহুল দাশ নয়ন, প্রতিদিনের বাংলাদেশের সুবল বড়ুয়া, দীপ্ত টিভির রুনা আনসারী, একুশে টেলিভিশনের রফিকুল বাহার, চট্টগ্রাম প্রতিদিনের আয়ান শর্মা, দৈনিক পূর্বকোণের বিশ্বজিৎ রাহা, দৈনিক আজাদীর আমিনুল ইসলাম মুন্না, ডিবিসি টেলিভিশনের মাসুদুল হক, রাশেদ মাহমুদ, আমাদের সময়ের ব্যুরো প্রধান হামিদ উল্যাহ, ভোরের কাগজের সমরেশ বৈদ্য ও সি প্লাস টিভির সৌরভ ভট্টাচার্য্য।

এছাড়া- রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত, আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও ফরিদ মাহমুদ, সাবেক নগর ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রনি, ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন ও নুর মোস্তফা টিনু, মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছোট ছেলে বোরহানুল হাসান, আওয়ামী লীগ নেতা শরাফতুল্লাহ চৌধুরী ওয়াসিম, খোরশেদ আলম চৌধুরী, জাহির রহমান সুমন, ওয়াসিম উদ্দিন, ব্ল্যাক শামীম, আরশেদুল আলম বাচ্চু, দিদারুল আলম মাসুম, সনৎ বড়ুয়া, সিরাজুল ইসলাম, জাকারিয়া দস্তগীর, এয়ার মোহাম্মদ ও আজিজ উদ্দিন চৌধুরীকে এই মামলায় আসামি করতে আবেদন করা হয়েছে।

মামলার অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে বাদীর আইনজীবী এনামুল হক বলেন, “আন্দোলনের সময় ছাত্রদের এবং বাদীকে মারধর করা হয়েছে– অভিযোগের এটুকু জানি। বাকি অভিযোগ বিষয়ে আমি জানি না।

“ফাইলিং লইয়ার কে সেটাও জানি না। শুনানির সময় আমাকে থাকতে বলেছিল তাই ছিলাম। তবে পুরো সময় ছিলাম না।”

বাদীর আরেক আইনজীবী মো. রেজাউল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আবেদনে বিস্তারিত আছে। বাদী বলতে পারবেন কী কী অভিযোগ। আমার চেম্বার থেকে ফাইলিং করা হয়েছে। অনেক বড় অভিযোগ। আমি সব জানি না।”

এরপর বাদী হাসিনা মমতাজের ফোন নম্বর জানতে চাইলে আইনজীবী মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, “মামলার আবেদনে উনার নাম-ঠিকানা আছে, সেটাই উনার তথ্য। উনি একজন মহিলা। আপনার সাথে উনি টেলিফোনে এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করবেন।”

পরে বাদী হাসিনা মমতাজের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। কয়েক মিনিট পর অন্য একজন ব্যক্তি অন্য একটি মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে নিজেকে হাসিনা মমতাজের ভাই এস এম মহিউদ্দিন জুয়েল বলে পরিচয় দেন।

মামলার আবেদনে অভিযোগ কী কী জানতে চাইলে এস এম মহিউদ্দিন জুয়েল বলেন, “আপনাকে এজাহার দিই? সেখানে বিস্তারিত আছে। আর কী জানতে চান?”

মহিউদ্দিন জুয়েল দাবি করেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের সবাইকে বাদী চেনেন।

মামলার আবেদনে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত ও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী হাসিনা মহিউদ্দিনের পরিকল্পনা ও অর্থায়নে অন্য আসামিরা মিলে বিভিন্ন অপরাধ করেছেন বলে দাবি করা হয়েছে।

আবেদনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তার মধ্যে ‘বিভ্রান্তিমূলক ও মিথ্যা’ সংবাদ প্রচার, স্বৈরাচারী সরকারের অপকর্ম ও দুর্নীতি ‘ধামাচাপা দেওয়া’, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলা-নির্যাতনের ছবি প্রকাশ না করার মত বিষয় রয়েছে।

এমনকি আন্দোলনরত ছাত্রদের অপহরণ করে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে মিথ্যা মামলায় পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া, আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে বৈঠক করা, ৪ অগাস্ট নিউ মার্কেট মোড়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটকে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেওয়া, এরপর সেদিন চেরাগী পাহাড় মোড়ে আসা শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে হত্যার চেষ্টা করা, এসব ঘটনার বস্তুনিষ্ট সংবাদ প্রকাশ না করা, গণমাধ্যমের গাড়ি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া, আন্দোলনের সময় অভিযোগকারীকে মারধর ও অপহরণের চেষ্টার মত অভিযোগ করা হয়েছে।

একাধিক দিনের একাধিক ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে মামলার আর্জিতে। দুয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও কয়েকজন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তারা সেসব জায়গায় উপস্থিত ছিলেন।

কিন্তু বাকিদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কোনো অভিযোগের উল্লেখ নেই। এমনকি কে কোন অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাও স্পষ্ট করা হয়নি।

আবেদনে দণ্ডবিধির ১০৯, ১১৫, ১৫৩ (এ), ১৭৭, ২০২, ২০৩, ৩২৩, ৩২৬, ৩৪, ৩০৭, ৩২৯, ৩৩৮, ৩৪২, ৩৫৫, ৩৬৪, ৩৭৯, ৩৮৬ ও ৫০৬, ৫২৪ ও ৩৫৪ ধারায় এবং ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩,৪ ও ৬ ধারায় মামলা গ্রহণের আর্জি জানানো হয়েছে।

পাশাপাশি বাদীর করা অভিযোগ সরাসরি আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিরও আবেদন করা হয়েছে।

শুনানি শেষে আদালত বিকেলে আদেশ দেয়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন কর্মকর্তাকে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয় সেখানে।
 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়