মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ১ আশ্বিন ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পাইকারি হারে দুর্নীতিবাজ ধরা হচ্ছে, দুদক ঢেলে সাজানোর কোন উদ্যোগ

পাইকারি হারে দুর্নীতিবাজ ধরা হচ্ছে, দুদক ঢেলে সাজানোর কোন উদ্যোগ

দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরো কার্যকর, শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করতে সংস্থাটির সংস্কার জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সব সেক্টর থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য প্রকাশ হতে শুরু করেছে। তবে দুর্নীতির এই রাহুগ্রাস চলার সময় নখদন্তহীন দুদকের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ১৫ বছর ধরে স্বাধীন এই সংস্থা দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।


দুর্নীতি দমন কমিশন ঢেলে সাজানোর এখনই সময়এই অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে দুদককে ঢেলে সাজানোর অন্তত ১০টি পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, কমিশন গঠনে স্বচ্ছতা, নিজস্ব স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট, আইন ও বিধির বিতর্কিত ধারা সংশোধন, যুগোপযোগী, আধুনিকায়নসহ দুদকের অন্যান্য সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। সংস্থাটির প্রয়োজনীয় সংস্কারের এখনই উপযুক্ত সময়। যথাসময়ে এই সংস্কারকাজ করা না গেলে স্বাধীন এই সংস্থা কখনো জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদককে ঢেলে সাজানোর এখনই উপযুক্ত সময়। জন্মলগ্ন থেকে সরকারদলীয় লোকদের সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার হিসেবে বসানো হয়েছে। ফলে দুদক সরকারের উচ্চ পর্যায়ে হাত দেয়নি। কমিশনে এমন লোকদের বসাতে হবে, যাঁরা দলীয় প্রভাবমুক্ত, পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতার জন্য সুপরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত; যাঁরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের দুর্নীতিতে হাত দেওয়ার সাহস রাখেন।’ 

তিনি আরো বলেন, দুদক এখনো আমলাতন্ত্রের কাছে জিম্মি। আমলাতন্ত্রের প্রভাব থেকে দুদককে মুক্ত করতে হবে। আইনের সংস্কারের পাশাপাশি দুদকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা চিহ্নিত করে এর সমাধান করতে হবে। নয়তো স্বাধীন এই সংস্থা কখনোই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না।

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, দুদকের গোড়াতেই গলদ রয়েছে। দেশকে দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে বাঁচাতে হলে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থার আমূল সংস্কারের সময় এখনই, বরং দেরি হয়ে যাচ্ছে। কারণ যেসব অপরাধের ফলে মামলা করা যায়, সেখানে দুদক মামলা না করে সেই সনাতন পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। কমিশনের আমূল সংস্কার করতে হবে। একে গতিশীল করতে প্রয়োজনে কমিশন পরিবর্তনসহ প্রেষণে থাকা মহাপরিচালক (ডিজি), পরিচালকদের পরিবর্তন করতে হবে। দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তাদের আরো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে।

দুদক আইন, ২০০৪-এর ৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন তিনজন কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত হবে এবং তাঁদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করবেন।’ আইনের ৭(১) ধারায় বাছাই কমিটি গঠন এবং সেখানে কারা থাকবেন তা বলা হয়েছে। অর্থাৎ বছাই কমিটি যে ছয়জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবে, সেখান থেকেই রাষ্ট্রপতি একজনকে চেয়ারম্যান ও দুজনকে কমিশনার নিয়োগ করবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশে যাঁদের নাম প্রস্তাব করা হয় তাঁরা সবাই ‘মাই ম্যান’ খ্যাত হয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে কমিশনার বাছাইয়ের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। কমিশনার বাছাইয়ের সমগ্র প্রক্রিয়ায় আরো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। এ ছাড়া যেহেতু দুদকের সব ক্ষমতা চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারের ওপর ন্যস্ত, তাই শক্তিশালী আইনি ভিত্তির জন্য কমিশনকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে হবে।

দুদক আইন, ২০০৪-এর ৩৩ ধারায় কমিশনের নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট গঠন এবং এর সার্বিক কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে। আইনের ৩৩(১) ধারায় বলা হয়, ‘এই আইনের অধীন কমিশন কর্তৃক তদন্তকৃত এবং স্পেশাল জজ কর্তৃক বিচারযোগ্য মামলাসমূহ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে কমিশনের অধীনে এর নিজস্ব একটি স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট থাকবে।’ তবে আইনে থাকলেও গত ২০ বছরেও কমিশনের স্থায়ী নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট গঠন করা হয়নি। বরাবরই দলীয় আইনজীবীরা এই প্রসিকিউশন প্যানেলে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। ফলে সরকার পরিবর্তন হলেই প্রসিকিউশন প্যানেলের আইনজীবীদের পরিবর্তন হয়। এতে একদিকে দুদকের সব মামলায় সরকারদলীয়রা খালাস পান, অন্যদিকে বিরোধীদলীয়দের দমনে হাতিয়ার হিসেবে দুদককে ব্যবহার করা হয়।

দুদক আইন, ২০০৪-এর ৩(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই কমিশন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হবে।’ স্বাধীন কমিশন হতে হলে এখানকার কর্মকর্তাদেরও কাজের স্বাধীনতা থাকতে হবে। তবে দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা ২০০৮-এর ৫৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যা কিছু থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ না দর্শিয়ে কোনো কর্মচারীকে নব্বই দিনের নোটিশ দিয়ে অথবা নব্বই দিনের বেতন নগদ পরিশোধ করে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করতে পারবে।’ এই ধারা নিয়ে এরই মধ্যে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। মূলত দুদক আইন ও কর্মচারীদের চাকরি বিধিমালা পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। কর্মকর্তাদের মাথার ওপর এই খড়্গ থাকলে তাঁদের পক্ষে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করা কখনো সম্ভব নয়।

দুদকের অন্যতম বড় সমস্যা হলো প্রেষণ। এ জন্য একে দুদকের গলার কাঁটা বলা হয়। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো—প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা কোনো অপকর্ম করলে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই কমিশনের। এ ছাড়া দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে এসব কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা ও ধারণা না থাকায় কমিশনের সুনাম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

দুদকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার অভিযোগ আসে। যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হয় মাত্র ১০ থেকে ১২টি অভিযোগ। বাকি প্রায় চার হাজার ৯৯০টি অভিযোগের বিষয়ে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় না। মূলত এটিই দুদকের দুষ্টচক্র। অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটি (যাবাক) নামে দুদকে একটি সেল রয়েছে। কমিশন সৃষ্টির পর থেকে এই সেলের প্রধান হয়েছেন সব সময় একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। ফলে যাবাক কখনোই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি।

বিদেশে পাচার করা সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনতে হলে মানি লন্ডারিং ইউনিটকে আরো শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। পাচার রোধে দেশে দুদকসহ রাষ্ট্রীয় সাতটি সংস্থা কাজ করছে। তবে এসব সংস্থার মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতা রয়েছে। পাশাপাশি সম্পদ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিদেশ থেকে সম্পদ ফিরিয়ে আনতে হলে দুদককে পর্যাপ্ত আইনি ক্ষমতা দিতে হবে। বিভিন্ন দেশের দুর্নীতি দমন সংস্থার সঙ্গে দুদকের এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা চুক্তি করতে হবে।

রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করতে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল করতে হবে। অনুসন্ধান থেকে প্রসিকিউশন, সব কাজ ম্যানুয়ালি করার পরিবর্তে আধুনিক সফটওয়্যারের (ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড প্রসিকিউশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম—আইপিএমএস) মাধ্যমে করতে হবে। এতে কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজগুলো দ্রুত ও সহজে করা যাবে। কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শেষে আইপিএমএসের পরীক্ষামূলক ব্যবহারও করা হয়েছে। তবে অজ্ঞাত কারণে এর পুরোপুরি ব্যবহার শুরু হয়নি।

দুদক কর্মকর্তাদের কাজে আরো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তৈরি করতে হবে। দুদকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কার্যক্রম কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের জন্য দুদকের অভ্যন্তরে পৃথক ইন্টেলিজেন্স সেল গঠন করতে হবে। এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিবছর সম্পদ বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক করতে হবে, যা সংস্থাটির ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত থাকবে।

দুদককে শক্তিশালী করতে হলে এর সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বর্ধিতভাবে ৬৮টি দুদকের কার্যালয় স্থাপন সংক্রান্ত অর্গানোগ্রাম চূড়ান্ত করে অনুমোদন করতে হবে। এগুলো হলো : ৬৪টি জেলা কার্যালয়, ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি মহানগর কার্যালয়, এয়ারপোর্ট ও স্থলবন্দরে দুটি কার্যালয়। এ ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), ব্যাংকসহ প্রয়োজনীয় দপ্তরগুলোর সার্ভারে দুদকের প্রবেশের অ্যাকসেস থাকতে হবে।

দুদকের মামলায় আপিলে চূড়ান্ত রায় হওয়ার পর রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা সম্পদের একটি অংশ দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পুরস্কার বা কাজের প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া দুদক কর্মকর্তাদের জন্য ঝুঁকি ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। দুদকে পদোন্নতির জট, পরিবহন সমস্যার সমাধান ও প্রয়োজনীয় সোর্স মানির ব্যবস্থা করতে হবে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়