বৃহস্পতিবার   ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৩ আশ্বিন ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আপডেট: ২০:২৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সংস্কারের রূপরেখা দিলেন ইউনূস

সংস্কারের রূপরেখা দিলেন ইউনূস

ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলন থেকে উৎসারিত আকাঙ্ক্ষার উপর ভর করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতার বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এক মাসে সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ ও উদ্যোগের কথা তুলে ধরে সবাইকে নিজস্ব জায়গায় সংস্কার করার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, “আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমরা একসঙ্গে সংস্কার করব। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। আপনারা নিজ নিজ জগতে সংস্কার আনুন। একটা জাতির সংস্কার শুধুমাত্র সরকারের সংস্কার হলে হয় না।“

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার দ্বিতীয় মাসেও দেশবাসীর দৃঢ় আস্থা তৈরির প্রচেষ্টা চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “ধৈর্য ধরুন এই কথাটি আমি মোটেই আপনাদের বলব না।

“আমরা সবাই অধৈর্য হয়ে পড়েছি এতসব কাজ কখন যে শেষ হবে এটা চিন্তা করে। আমরা অধৈর্য হব। কেন হব না। কিন্তু সঠিকভাবে কাজ করব। কাজে কোনো অধৈর্যের চিহ্ন রাখব না।”

দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস তিন দিনের মাথায় তৃতীয় দফায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ‘গণঅভ্যুত্থানের বার্তা ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য একটি অভূতপূর্ব সময় ও সুযোগ’ অর্জন করেছে সরকার।

“এর বাস্তবায়ন তথা বাংলাদেশে ফ্যাসিজম বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা রোধ এবং জনমালিকানা ভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে কিছু জাতীয়ভিত্তিক সংস্কার সম্পন্ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। উক্ত সংস্কার ভাবনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।”

জনগণের ভোটাধিকার ও জনগণের মালিকানায় বিশ্বাস করার কারণে নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার ভাবনায় গুরুত্ব পাওয়ার কথা ৩৩ মিনিটের ভাষণে তুলে ধরেন তিনি।

মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা মনে করি নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একাধিপত্য ও দুঃশাসন মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বা এর মাধ্যমে এক ব্যক্তি বা পরিবার বা কোনো গোষ্ঠীর কাছে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।

“এসব আশঙ্কা রোধ করার জন্য নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের কথা আমরা ভাবছি।”

নির্বাচনব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত চার প্রতিষ্ঠান পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কারও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জনমালিকানাভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়ও অবদান রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”

পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করার জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার কথা বলেন সরকারপ্রধান।

সংস্কার করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ছয়টি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে এই কমিশনগুলো পরিচালিনা করার দায়িত্ব দিয়েছি। এরপর আরও বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া আমরা অব্যাহত রাখব।”

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক -সুজন এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্র ও সংস্থাপন সচিব সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের প্রধান হিসেবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আইনজীবী শাহদীন মালিককে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এসব কমিশনের অন্য সদস্যদের নাম কমিশন প্রধানদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হবে। কমিশনগুলোর আলোচনা ও পরামর্শসভায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ছাত্র, শ্রমিক, জনতা আন্দোলনের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।

তিনি বলেন, “পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হওয়ার পর কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে শুরু করতে পারবে বলে আশা করছি এবং এটি পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আমরা ধারণা করছি। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শসভার আয়োজন করবে।

“চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র সমাজ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি পরামর্শ সভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। এতে এই রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার একটি ধারণাও দেওয়া হবে।”

সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। এ সংস্কারের মাধ্যমে আমরা জাতি হিসেবে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে চাই। আমাদের এই যাত্রা আমাদের পৃথিবীর একটি সম্মানিত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুক এটাই আমাদের সবার কাম্য।”

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকরাও সংস্কারে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বলে তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ”সবার পরামর্শ নিয়ে এখন আমাদের অগ্রসর হওয়ার পালা।”

আইন নিজের হাতে নিলে শাস্তি পেতে হবে

কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।

জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেন, “কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।”

বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন কোনো কাজ কেউ কোনোভাবেই করবেন না।”

স্বৈরাচার মুক্ত দেশ গড়তে এবং গণতান্ত্রিক দেশের জন্য তিনি আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আপনাদের আমাদের সন্তানদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রূপরেখা তৈরি করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

”আর যেন আমাদের কোন স্বৈরাচারের হাতে পড়তে না হয়, আমরা যাতে বলতে পারি আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশে বসবাস করি, আমরা যাতে সকলেই দাবি করতে পারি যে এই দেশটি আমাদের - আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি।”

“আমরা আমাদের দায়িত্বকালে যথাসম্ভব সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব,” বলেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের সরকারের প্রথম মাস কাটল। দ্বিতীয় মাস থেকে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি হিসেবে নতুন শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের সূচনা করতে চাই। এটা দেশের সবার কাম্য। দেশের নতুন প্রজন্ম নির্ভয়ে যেন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি।“

তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্পে দাবি দাওয়া নিয়ে অসন্তোষের জের ধরে কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য করার কথা তুলে ধরে তিনি শ্রমিক ও মালিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করার কথা বলেন।

শ্রমিকদের কারখানা চালু রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, “মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এসব সমস্যার সমাধান আমরা অবশ্যই বের করব। আপনারা কারখানা খোলা রাখুন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখুন। দেশের অর্থনীতিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দিন। আমরা আপনাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান বের করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করব।”

‘মন খুলে আমাদের সমালোচনা করুন’

ফ্যাসিবাদী সরকার পতনের পর সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সবাইকে মন খুলে সমালোচনা করার আহ্বান জানিয়েছে।

তিনি বলেছেন, “'সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি, আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।”

গণমাধ্যম যাতে কোনো রকম বাধা বিপত্তি ছাড়া নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে সেজন্য একটি ’মিডিয়া কমিশন’ গঠন করা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউনূস।

তিনি বলেন, যেসব কমিশন সরকারসহ অন্য সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে তাদের পুনর্গঠন ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে তারা আরও শক্তিশালী হয়, জনকল্যাণে কাজ করে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের কথা জানান ইউনূস।

“সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ বাংলাদেশে বিদ্যমান সকল কালো আইনের তালিকা করা হয়েছে। অতি সত্ত্বর এ সকল কালো আইন বাতিল ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন করা হবে।”

সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ বহুল আলোচিত পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তির জন্য সহায়তা প্রদান করার কথাও বলেন তিনি।

সশস্ত্র বাহিনীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা

প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ধন্যবাদ জানান। প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের ভূমিকার কথাও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, ''দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বন্যা, খরা, ঝড়, বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় সহ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগে আপনারা সকলের শেষ ভরসার স্থান।''

তিনি বলেন, ''দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে আপনারা দেশের মানুষের পাশে থেকেছেন। দেশের স্বাধীনতার পক্ষে, সার্বভৌমত্বের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। দেশ গঠনেও আপনারা সবার আগে এগিয়ে এসেছেন। বিগত জুলাই হতে শুরু হওয়া গণ অভ্যুত্থান, বন্যা, নিরাপত্তা প্রদান, অস্ত্র উদ্ধারসহ সকল কার্যক্রমে আপনারা সফল ভাবে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে আসি আপনাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়