শনিবার   ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৫ আশ্বিন ১৪৩১

আজ ও কাল ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আপডেট: ২৩:৫৭, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ কেমন ’নির্মমতা’: গা শিউরে উঠছে, হতভম্ভ মানুষ, বিচার চাইছে

এ কেমন ’নির্মমতা’: গা শিউরে উঠছে, হতভম্ভ মানুষ, বিচার চাইছে

একজন মানুষকে পেট পুরে খাইয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরপর গ্রিলে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অন্য আরেকজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক থেকে ধরে নিয়ে একাধিকবার পিটিয়ে আধমরা করে ফেলা হয়েছে, হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন।

একই দিনে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দল বেঁধে এভাবে নির্মমভাবে হত্যার ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে, যে ফুটেজ পুরোটা দেখাও কঠিন। এসব ঘটনায় হতভম্ভ মানুষ শিউরে উঠেছে, চাইছে বিচার।

কিছুদিন আগেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে একই কায়দায় পিটিয়ে হত্যাকে ঘিরে সমালোচনার মধ্যেই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে ছড়িয়েছে ক্ষোভও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, “যে ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো আমাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে। রাজনৈতিক কারণে বা ব্যক্তিগত বিরোধিতা অথবা সন্দেহের বশে নির্যাতন করে মেরে ফেলা, এটি আসলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত রূপ।”

গত ৫ অগাস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে টানা সাড়ে ১৫ বছর পরাক্রম দেখিয়ে শাসন করা আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। গঠন হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু দেড় মাসেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি। হামলা, মারামারি, খুনোখুনি চলছেই।

গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহীর বিনোদপুর বাজারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ১০ বছর আগে তার হাত-পায়ের রগ এবং একটি পা কেটে দেয় একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এরপর থেকে রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন তিনি। সরকারের পতনের পর তাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যাকে পরিকল্পিত হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে মোল্লা শামীমকে ফটক থেকে ধরে নিয়ে বেদম পেটানো হয়। ভিডিও ফুটেজ দেখে সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বয়ককে বহিষ্কার করা হয়েছে। অন্য একটি বড় ছাত্র সংগঠনের কয়েকজনের পরিচয়ও সংবাদ মাধ্যমে আসছে, ভিডিওতে তাদের চেহারাও স্পষ্ট।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল হোসেন নামে যে যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তিনি যে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’, সে কথা ফোনে তার মামাত বোন ছাত্রদেরকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু স্বজনদের নম্বর তোফাজ্জেলের মুখস্থ, কেবল এই কারণে সেই কথা বিশ্বাস না করে আরও বেশি পেটানো হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বীভৎসতা

বুধবার সন্ধ্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে “সন্দেহজনকভাবে” ঘোরাফেরা করছিলেন তোফাজ্জল হোসেন। এই হলের কয়েকজন ছাত্রের ফোন চুরি হয়েছিল এদিন। তারা সন্দেহের বসে তোফাজ্জলকে হলের মূল ভবনের গেস্ট রুমে নিয়ে যায়, চলে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় ও কিলঘুষি।

এক পর্যায়ে তাকে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে খাবার খাওয়ায় শিক্ষার্থীরা। পরে দক্ষিণ ভবনের গেস্ট রুমে নিয়ে জানালার সঙ্গে হাত বেঁধে স্ট্যাম্প, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে বেধরক মারধর করা হয়।

তোফাজ্জল অচেতন হয়ে পড়লে তার দুই হাত একত্রে রেখে সেখানে স্ট্যাম্প রেখে দুই পাশে দুই ছাত্র উঠে চাপা দিতে থাকে।

বিষয়টি জানতে পেরে অচেতন তোফাজ্জলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ নেন হলেন আবাসিক শিক্ষক। রাত পৌনে একটায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

তোফাজ্জল হোসেনকে পেটানোর আগে তাকে ভাত খাইয়ে ভিডিও করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

বৃহস্পতিবার দুপুরে শাহবাগ থানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের সুপারভাইজার মোহাম্মদ আমানুল্লাহ অজ্ঞাত কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ ও শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ছয় জনকে আটক করে পুলিশে দেওয়া হয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জালাল আহমেদ, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের মোহাম্মদ সুমন, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মোত্তাকিন সাকিন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের আল হোসেন সাজ্জাদ, গণিত বিভাগের আহসান উল্লাহ এবং ওয়াজিবুল আলম।

৮ বছর আগে বাবা, ৫ বছর আগে মা এবং গত রোজায় বড় ভাইকেও হারান তোফাজ্জল। 

 

তোফাজ্জলের জীবনের করুণ কাহিনী

দুই ভাই আর বাবা-মা নিয়ে ছিল তোফাজ্জলের সংসার। আট বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা যান, পাঁচ বছর আগে মারা যান তার মা। এরপর তার আচরণে সমস্যা দেখা দেয়। বড় ভাই পুলিশের এসআই নাসির হোসেন তাকে দেখেশুনে রাখতেন, সেই ভাইও গত বছর ক্যান্সারে মারা যায়।

এরপর মামার পরিবার তোফাজ্জলকে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিনি পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন।

মরদেহ নিতে আসা মামাত বোন আসমা আক্তার তানিয়া জানান, আগের রাতে তোফাজ্জলকে আটকের পর তার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে তার বাবাকে ফোন করে ছাত্ররা। বলা হয়, ‘তোফাজ্জল মোবাইল ফোন চুরি করছেন। ছাড়াতে হলে ৩৫ হাজার টাকা দিতে হবে।’

তানিয়া তখন বাবার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ছাত্রদের ফোন করে তোফাজ্জলের কাহিনী জানান। বলেন, তিনি মানসিক রোগী। তাকে যেন পেটানো না হয়।

কিন্তু ছাত্ররা সে কথা বিশ্বাস করেনি। তাদের যুক্তি ‘মানসিক রোগীর এত ফোন নম্বর মুখস্থ থাকার কথা না।’

“ও যখন আমার আব্বার নম্বর, ওর ভাবির নম্বর, চাচাত ভাইদের নম্বর দিছে, তখন ওরে (তোফাজ্জল) আরও বেশি মারছে। ‘পাগলে ক্যামনে এত নম্বর মনে রাখে’ কইয়া আরো মারছে। কিন্তু সব পাগল তো এক রকম না, সব পাগলের আচরণ তো একই রকম না”, কাঁদতে থাকেন তানিয়া।

তোফাজ্জল প্রথমে কল করেছিলেন তার ভাবি শরিফা বেগমকে। তাকে হলে আটকে রেখে মারপিট করার কথা জানান। এরপর শরিফার মোবাইল ফোনে অন্য একটি নম্বর থেকে কল আসে। বলা হয়, দেবরকে বাঁচাতে চাইলে বিকাশ নম্বরে ২ লাখ টাকা পাঠাতে হবে।

ঢাকা মেডিকেল মর্গে নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কাজী গোলাম মোকলেসুর রহমান বলেন, “নিহতের সারা শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।”

তোফাজ্জলদের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলি ইউনিয়নে। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স করলেও মানসিক সমস্যার কারণে তিনি কোনো কাজকর্ম করছিলেন না।

‘বিচার চাই’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রকিবুল হক এই ঘটনাটি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না।  তিনি বলেন, “চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যারা এ ঘটনায় জড়িত, তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

“এ ধরনের হত্যা দেশের কয়েক জায়গায় ঘটেছে, এমন খবর সামনে এসেছে। এসব বন্ধ করা এবং জড়িতদের আইনের আওতায় আনা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।”

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, “শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘মব জাস্টিসের’ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তারা নিজেরাই বিচার করতে চান। কিন্তু যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তারা যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটায়, সেটা আতঙ্কের।”

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার তালেবুর রহমান বলেন, “ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, জড়িতদের চিহ্নিত করা ও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবির একাধিক টিম কাজ করছে।”

কী করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তোফাজ্জলকে হত্যার ঘটনা তদন্তে ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক আলমগীর কবীরকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে হল কর্তৃপক্ষ।

শুরুতে কমিটিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও পরে শুক্রবার প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ফজলুল হক হল পরিদর্শনের পর সাংবাদিকদের বলেন, “একজনকে ধরা হয়েছে যিনি এফ এইচ হল ছাত্রলীগের উপ-সম্পাদক ছিলেন। দীর্ঘ ১৫ বছরের একটা চর্চা, 'উন্মাদনা' আছে তাদের মধ্যে।”

প্রক্টর যার কথা বলেছেন, তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জালাল আহমেদ যিনি ছাত্রলীগ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অব্যাহতি নিয়ে সরকার পতন আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সরকার পতনের আগে থেকেই আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীরা হলে থাকতে না পারলেও আন্দোলনকারীদের একজন হিসেবে জালাল হলেই থাকছেন, তাদের সঙ্গেই উঠবস করছেন।

তদন্ত কমিটির সময় বাড়ানো হয়েছে কেন- এই প্রশ্নে প্রক্টর বলেন, “চারজনকে ভিডিও ও অন্যান্য তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে শনাক্ত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি মনে করছে, আরও দুষ্কৃতকারী আছে। তারা আমার কাছে আজকে রাত সময় চেয়েছেন, যেন দোষী সবাইকে ধরা যায়।”

এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে। ঘটনাটিকে ‘অমানবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত’ উল্লেখ করে মর্মাহত হওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলেও জানানো হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দফায় পিটুনির পর মৃত্যু

বুধবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেটে মহাসড়কের পাশে একজনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে মোল্লা শামীম। সেখানে তাকে পাকড়াও করে মারধর করে একদল শিক্ষার্থী।

এরপর তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় প্রান্তিক গেইটের ভেতরে। যেখানে ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে কাপড় বিক্রি হয়, সেখানে নিয়ে আরেক দফা মারধর করা হয়। এরপর জয় বাংলা গেইটে মারধর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মীদের কাছে তুলে দেওয়া হয়।

নিরাপত্তা কর্মীরা শামীমকে প্রক্টর অফিসের পাশের একটি কক্ষে রাখেন। সেখানেও তাকে আরও দুই দফা পেটানো হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, খবর শুনে পুলিশ আগেই এসেছিল, তবে প্রক্টর অফিসের ওই কক্ষে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। রাত সাড়ে ৮টার দিকে শামীমকে পুলিশে হস্তান্তর করা হলে তাকে গাড়িতে তোলে পুলিশ।

প্রক্টর রশিদুল আলম বলেন, “পুলিশে হস্তান্তরের সময়ও মনে হয়নি তিনি (শামীম) আশঙ্কাজনক।”

তবে ঢাকা জেলা পুলিশের এসপি আহম্মদ মুইদ বলেন, “আমরা তাকে উদ্ধার করে সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। হাসপাতালে পাঠানোর পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।”

আশুলিয়া থানা পুলিশ শামীমকে পাঠিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে। এ হাসপাতালের চিকিৎসক সেলিমুজ্জামান সুজন বলেন, “রাত সোয়া ৯টার দিকে শামীমকে নিয়ে আসার পর আমরা পরীক্ষা করে তাকে মৃত অবস্থায় পাই। দেখে মনে হয়েছে হাসপাতালে আনার কিছু আগেই ওনার মৃত্যু হয়েছে।”

শামীম সাভারের আশুলিয়া থানার কাঠগড়া এলাকার মোল্লাবাড়ীর ইয়াজ উদ্দিন মোল্লার ছেলে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের (৩৯ ব্যাচ) ইতিহাসের বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।

শামীমের মৃত্যুর পর রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে এ ঘটনার বিচার দাবি করেন তারা।

ভিডিওতে শনাক্ত

শামীমকে গণপিটুনি দেওয়া একাধিক ভিডিও ফুটেজে অন্তত সাতজনকে শনাক্ত করা গেছে, এদের পাঁচজনই ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িত। একজন আছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একজন সমন্বয়কও।

শামীম মোল্লাকে প্রথম মারধরের ভিডিও ফুটেজে লাঠি হাতে মারতে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আহসান লাবিবকে। ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের আতিককে লাথি দিতে দেখা যায়।

আহসান লাবিব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক। এই ঘটনায় তাকে এই পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখায় মারধরের ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িত সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া, রাজু আহমেদ, রাজন হাসান, হামিদুল্লাহ সালমান ও এম এন সোহাগকে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অন্যতম সমন্বয়ক জাহিদুল ইসলাম বলেন, "ক্যাম্পাসের ভেতর এ ধরনের পিটুনির ঘটনা আমাদেরকে অনিরাপদ বোধ করায়। আমরা সবাই ‘মব জাস্টিস’ নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত।"

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী নিশাত বিজয় বলেন, “বুয়েটে আবরার যখন রাত দুইটায় মারা যায়, ভোরের মধ্যে সব অপরাধীকে এমনকি অপরাধীদের রুমমেটদেরও ধরা হয়েছিল, বিচার হয়েছে। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরে একজনকে পেটানো হল, যারা পিটিয়েছে তারাই ফেসবুকে লাইভ করল, প্রত্যক্ষদর্শীদের ভিডিও, ছবি ভাসছে কিন্তু অপরাধী কেউ গ্রেপ্তার হল না কেন? দেখলাম বৈষম্য বিরোধী এক সমন্বয়ককে বহিষ্কার করা হয়েছে, অথচ আরও দুই-তিনজন সমন্বয়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারাই আবার খুনের বিচার চেয়ে মিছিল করছে!

“ছাত্রদলের ১৫ বছর আগের সেক্রেটারি সাঈদকেও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিতে, আর রাজু, রাজনসহ কয়েকজনের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে পেটাতে, অথচ কেউই গ্রেপ্তার হয়নি। ইমরান নামের ছাত্রদলের মারা যাওয়ার আগে ফেসবুকে দম্ভভরে লিখেছে ‘পিটিয়ে আসলাম’, সেও গ্রেপ্তার হয়নি।”

কী ব্যবস্থা নিল জাহাঙ্গীরনগর প্রশাসন

শামীম হত্যার ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন ও ৮ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করার কথা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (সাধারণ প্রশাসন) মো. মাহতাব-উজ-জাহিদ।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্বাধীন সেনকে প্রধান করে করা এই তদন্ত কমিটিকে ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

প্রক্টরিয়াল বডির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ভিডিও ফুটেজ ও ছবির ওপর ভিত্তি করে ‘সরাসরি সম্পৃক্ত’ ৮ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করার কথাও জানানো হয়েছে।

এরা হলেন: সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৬ ব্যাচের মো. রাজন মিয়া, ৪৫ ব্যাচের রাজু আহম্মদ, ইংরেজি বিভাগের ৫০ ব্যাচের মো. মাহমুদুল হাসান রায়হান, ইতিহাস বিভাগের ৪৪ ব্যাচের জুবায়ের আহমেদ, ইংরেজি বিভাগের ৪৯ ব্যাচের হামিদুল্লাহ্ সালমান, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ৪৯ ব্যাচের আতিকুজ্জামান আতিক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭ ব্যাচের সোহাগ মিয়া, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৯ ব্যাচের আহসান লাবিব।

বাঁচতে পারেননি অঙ্গহারা মাসুদও

গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহীর বিনোদপুর বাজারে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালে একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা তার ওপর হামলা চালিয়ে তার এক পা কেটে নেওয়ার পাশাপাশি অন্য পা ও হাতের রগ কেটে দেয়।

সেই হামলার পর থেকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের স্টোর কিপার পদে কর্মরত ছিলেন।

হত্যার চার দিন আগে তিনি একটি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছিলেন। সেই মেয়ের জন্যই ওষুধ কিনতে দোকানে গিয়েছিলেন।

১০ বছর আগে যে ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা হামলা করেছিলেন, সেই সংগঠনের নেতাকর্মীরাই এবারও হামলা করেছে বলে অভিযোগ আছে।

মাসুদকে হত্যার ঘটনায় ৮ সেপ্টেম্বর নগরীর মতিহার থানায় মামলা করেন তার বড়ভাই মো. বেহেস্তী। মতিহার থানার ওসি মো. আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, তারা কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেননি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।”

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, “এগুলো যে কোনো উপায়ে বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরি হবে।

“ভিন্ন মত, আদর্শ বা ভিন্ন ধর্মের সে কেন নিরাপদ থাকবে না? অন্তর্নিহিত কারণ খোঁজার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং রাষ্ট্রেরও যেমন মনযোগী হওয়া প্রয়োজন, তেমনি সমন্বিত ঐক্যের ভিত্তিতে একটি অঙ্গীকারও প্রয়োজন। যতক্ষণ পর্যন্ত একটি দেশের নাগরিকরা সবাই সবার কাছে নিরাপদ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই নিরাপদ না।”

সর্বশেষ

জনপ্রিয়