আন্দোলনের ৯ দফা নিয়ে বললেন সমন্বয়ক কাদের
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রাণহানির পর যে ৯ দফা দাবি সামনে আনা হয়, সেটি ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদকের পরামর্শে করা হয় বলে প্রকাশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের।
শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম নিজের পরিচয় প্রকাশের পরদিন ফেইসবুকের এক পোস্টে সেই ঘটনাটি প্রকাশ করেন সমন্বয়ক কাদের।
শিবিরের সেই নেতার নাম বলা হয়েছে ‘ফরহাদ’, যদিও শিবিরের পক্ষ থেকে তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির নাম ঘোষণা করা হলেও সেক্রেটারির নাম এখনও জানানো হয়নি।
এই নয় দফা দাবির পথ ধরেই আসে সরকার পতনের এক দফা। ৩ অগাস্ট এক দফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণার পর দ্বিতীয় দিনেই সরকার পতন ঘটে, ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যান টানা সাড়ে ১৫ বছরের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
‘নয় দফা’ তৈরির পেছনের গল্প তুলে ধরে সমন্বয়ক কাদের ফেসবুক পোস্টে লিখেন, “নয় দফা প্রচার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল শিবির। যেহেতু নেট নাই, গোলাগুলি-কারফিউয়ের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশরীরে হাউজে হাউজে পৌঁছে দিয়েছে, বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা তারাই করেছে।।”
শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ কীভাবে হল, সেটিও তুলে ধরেন সমন্বয়ক কাদের।
তিনি জানান, আন্দোলনের শুরুতেই বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তাকে ডেকে নিয়ে একজনের সঙ্গে পরিচয় করান এবং পরে আন্দোলনের জন্য একাধিকবার তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
“পরবর্তীতে জানতে পারি তিনি ঢাবি শিবিরের ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু তখনও শিবিরের সভাপতি এবং সেক্রেটারির সাথে ওইভাবে যোগাযোগ হয় নাই।“
ফেসবুকে তুলে ধরা এই বক্তব্যের বিষয়ে সমন্বয়ক আবদুল কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।
১৬ জুলাই রাতে অনলাইন বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত
১৬ জুলাই বিক্ষোভে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদসহ ৬ জন নিহত হওয়ার রাতে সমন্বয়করা একটা অনলাইন বৈঠক করে আন্দোলনটি কেবল কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমিত না রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
আবদুল কাদের লেখেন, “তখন সবাই হই হই করে বলে উঠে, ছয়টা লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার হতে পারে না। পরবর্তীতে দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা করা হয়। এই আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিসহ আরও কিছু দাবি দাওয়া উঠে আসে।”
১ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়াসহ নানা কর্মসূচি দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে একেবারে ‘নির্বিকার-নির্লিপ্ত’ মনোভাব দেখার কথাও তুলে ধরেন কাদের।
তিনি লেখেন, “আলাপ-আলোচনার ধার ধারে নাই সরকার। কেবল হাই কোর্টের কাঁধে বন্দুক রেখে চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বেগতিক হয়ে যায়, ৬ জন শহীদ হয়, ওই দিনই সরকার আলোচনার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয়, আমাদেরকে বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ দিতে থাকে আলোচনায় বসার জন্য। কিন্তু আমরা আলোচনার আহ্বানকে বরাবরের মতই প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করি। যদিও ভেতর-বাহির থেকে আলোচনায় বসার নানারকম চাপ আসছিল।”
১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজায় পুলিশ গুলি চালালে কাদেরসহ কয়েকজন আহত হন। গুলিবিদ্ধ হন হান্নান মাসউদ।
“তখন থেকেই আমরা আন্দোলন পরিচালনা করে যাওয়ার স্বার্থে কৌশলী অবস্থান নিয়ে গ্রেপ্তার এড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই।”
১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দিন কাদের ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এক বাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে চলে যান। সেই রাতেই ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। তখন কর্মসূচি চালিয়ে যেতে, গ্রেপ্তার এড়াতে বার বার জায়গা পরিবর্তন করতে থাকেন কাদেররা। কারও সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।
শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারির ফোন
কাদেরের ভাষ্য, ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলন করার সময় শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি ফরহাদ তাকে ফোন দিয়ে বলেন, “আন্দোলনরত কয়েকজন সমন্বয়ক সরকারের মন্ত্রীদের সাথে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে, ‘এত এত শহীদের রক্তের সাথে বেইমানি করতেছে তারা’, আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। কিছু দাবি-দাওয়া দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, মানুষের সাথে বেইমানি করা যাবে না।”
এই বক্তব্য সায় দেন কাদের। তিনি লেখেন, “আমাদের তো আগেই অবস্থান ছিল আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। তাছাড়া মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাতের মিটিংয়ে ঠিক করা কিছু দাবি দাওয়া আমার মাথায় আছে।”
সে আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার মত নেতারা মাঠে ছিলেন না। আসিফ-নাহিদকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না তারা।
“আমি সাত-পাঁচ না ভেবে রিস্ক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ওইদিন জুমার নামাজের পর পরই যাত্রাবাড়ীতে কয়েকজন শহীদ হয়, সবগুলা আমার চোখের সামনেই ঘটতেছে। মানুষকে ‘পাখির মত’ গুলি করে মেরে ফেলতেছে, এটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারতেছিলাম না।”
কিছুক্ষণ পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সেক্রেটারি তাকে আবারও ফোন দেন।
কাদের লেখেন, “বলতেছে, ‘কিছু দাবি দাওয়া খসড়া আকারে করছি, তোমার সাথে আলোচনা করি’৷
“আমাদেরও যেহেতু আগেই আলোচনা হয়েছিল অনেকগুলো দাবির ব্যাপারে। সেগুলো তখন উনার সাথে আলোচনা করে সমন্বিতভাবে তৈরি হয় ৯ দফা।”
শিবির নেতা ফরহাদ সেদিন একে একে কিছু দাবি বলেন।
“যেগুলা খুব কমন দাবিদাওয়া, যেমন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, ছাত্র হত্যার সাথে জড়িত পুলিশ প্রশাসনকে বরখাস্ত, সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা, ভিসির পদত্যাগ। যেগুলা ৬ জন শহীদ হওয়ার পরে মঙ্গলবার রাতের বৈঠকের আলোচনাতেই আমরা ভেবেছিলাম। এছাড়া মানুষজনও সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু দাবিদাওয়া জানিয়ে আসছিল।”
কাদেরের ভাষ্য, শেষের দিকে গিয়ে শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারি একটা দাবি যোগ করেন, “ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।”
এটা কাদের মানেননি। দীর্ঘক্ষণ এটা নিয়ে আলোচনা হয়।
“পরে আমি বললাম, ঢালাওভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা যাবে না, এক্ষেত্রে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলতে পারেন।”
পরে ঠিক হয়, “লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।”
শিবিরের পরামর্শে নতুন ফোন ও সিম
সমন্বয়ক কাদের জানান, এরপর শিবির তাকে নতুন একটা সিম এবং মোবাইল ফোন সংগ্রহ করার পরামর্শ দেয়।
“আমি স্টুডেন্ট এর বাসা থেকে সিম নিয়ে ওই নম্বরটা নয় দফা সংবলিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির সাথে দিয়ে দিলাম। ওইদিন সন্ধ্যায় বাসা থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে হেঁটে গিয়ে পরিচিত সাংবাদিকদেরকে ফোন দিয়ে নয় দফার বিষয়টা জানাইলাম।”
‘টুকটাক ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে’ ক্যাম্পাসের সেই সাংবাদিকদের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল।
হাতের বাটন ফোন দিয়ে মেসেজ করে একটা একটা করে দফা লিখে সেই সংবাদ কর্মীকে পাঠান কাদের। কাউকে আবার মুখে বলেছেন। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গেও সেই রাতে কথা বলেন তিনি।
এরপর থেকে প্রতিদিন রাতের বেলায় বাসা থেকে দূরে চলে যেতেন। ফোন অন করে সাংবাদিকদের সাথে ২-৩ ঘণ্টা কথা বলে আবার ফোন বন্ধ করে বাসায় ফিরতেন।
“আমার বাসা ছিল যাত্রাবাড়ী থানার পাশেই। গ্রেপ্তারের আতঙ্ক, তারপরও বাসায় থাকতে হত। শুরুতেই যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। কোনো রাত মসজিদে কাটাইছি, কোনো রাত অর্ধেকটা বাহিরে কিংবা বাসার ছাদে কাটিয়ে শেষ রাতে বাসায় ফিরেছি।”
“এই তো ঐতিহাসিক নয় দফা, আমাদের নয় দফা,
‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা’ থেকে মুক্তি লাভের সনদ”, লিখেন তিনি।