আগের সরকারের চুক্তিতে নিয়োগ বাতিল করে এখন ঢালাওভাবে এ নিয়োগ দিচ্ছেন ড. ইউনূস
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চুক্তিতে থাকা কর্মকর্তাদের নিয়োগ বাতিল করলেও বর্তমান সরকার নিজেরাই একের পর এক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে চলেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে ঘোষণা দিয়েছিল, চুক্তিতে থাকা সব কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করা হবে। গত তিন মাসে ১০১ কর্মকর্তার চুক্তি বাতিল হয়েছে; যাঁরা শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তবে একই সময়ে ৬৫ জন কর্মকর্তাকে চুক্তিতে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ ১২ মন্ত্রণালয়ে দুই বছর মেয়াদে সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চুক্তিভিত্তিক। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের ঊর্ধ্বতন পদে, কৃষি, বিটিআরসি, সিটি করপোরেশনেও চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ সময় সহকারী সচিব থেকে জ্যেষ্ঠ সচিব পর্যন্ত মোট ৮০ জন কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ছয় থেকে আট বছর আগে যেসব কর্মকর্তা সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন, তাঁদের চুক্তিতে সচিব পদে বসানো হচ্ছে। বয়সের ভারে তাঁদের অনেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ। আবার তাঁদের সঙ্গে বর্তমান কর্মকর্তাদের যোগাযোগ নেই। প্রশাসনের অনেক কিছু তাঁদের অজানা, অনেক কর্মকর্তাকে তাঁরা চেনেন না। এ কারণে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর একদিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করছে; একই সময়ে চুক্তিতে নতুন করে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, সরকার চাইলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ঢালাওভাবে এ নিয়োগ দিচ্ছে। তদবিরে কারও কারও পছন্দের কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যাচ্ছেন। এটি দৃষ্টিকটু। এতে প্রশাসনের কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, গত তিন মাসে সচিব পদে পদোন্নতি পান ১২ জন কর্মকর্তা। গ্রেড-১ পদে তিনজন, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩৫ জন, যুগ্ম সচিব পদে ২২৬ জন এবং উপসচিব পদে ১২৫ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসে মোট ৫০১ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
যদিও গত ১৫ বছরে বঞ্চিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি বঞ্চিত সেজে কিছু সুবিধাভোগী কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যাঁর বিরুদ্ধে অপরাধে জড়ানোর অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলছে এমন কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন।
এদিকে এক মাসের বেশি সময় ধরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ খালি। আরও তিনটি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ শূন্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসনে বড় কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। যা হচ্ছে নিয়মিত (রুটিন) কাজ।
চুক্তিতে নিয়োগ পেলেন যাঁরা:
প্রশাসনের শীর্ষ পদ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। অন্তর্বর্তী সরকার গত ৮ অক্টোবর শেখ আব্দুর রশীদকে দুই বছরের জন্য এ বিভাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। বিসিএস-৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা তাঁর ব্যাচে মেধাক্রমে প্রথম ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে তাঁকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে। ২০১৬ সালে অতিরিক্ত সচিব থেকে তিনি অবসরে যান। আট বছর অবসরে থাকার পর আবার প্রশাসনে ফিরেছেন তিনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় মো. মোখলেস উর রহমানকে। বিসিএস-৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা ২০০৯ থেকে ওএসডি ছিলেন। অতিরিক্ত সচিব থেকে ২০১৫ সালে অবসরে যান তিনি এবং ৯ বছর পর প্রশাসনে ফিরে এসেছেন।
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জন বিভাগে জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় বিসিএস–৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা নাসিমুল গনিকে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০০৯ থেকেই ওএসডি ছিলেন তিনি। অতিরিক্ত সচিব থেকে ২০১৬ সালে অবসরে যান তিনি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে জ্যেষ্ঠ সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় এম এ আকমল হোসেন আজাদকে। বিসিএস-৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তাও ২০০৯ থেকে ওএসডি ছিলেন। ২০১৭ সালে অতিরিক্ত সচিব থেকে অবসরে যান তিনি। সাত বছর পর তিনি প্রশাসনে ফিরেছেন।
মমতাজ আহমেদকে চুক্তিতে দুই বছরের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিসিএস-৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা ২০০৯ সালে ওএসডি হন। ২০১৪ সালে যুগ্ম সচিব থাকা অবস্থায় অবসরে যান তিনি। ১০ বছর পর তিনি প্রশাসনে ফিরেছেন।
বিসিএস-৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা মো. নিয়ামত উল্লাহ ভুঁইয়াকে দুই বছরের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যপদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে উপসচিব থেকে অবসরে যান তিনি। বিসিএস-৮৪ ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা সিদ্দিক জোবায়েরকে দুই বছরের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে অতিরিক্ত সচিব থেকে অবসরে যান তিনি।
বিসিএস-৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তা এ এস এম সালেহ আহমেদকে চুক্তিভিত্তিক ভূমি মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে তাঁকে ওএসডি করা হয়। ২০১৯ সালে যুগ্ম সচিব পদ থেকে তিনি অবসরে যান। এ ছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব পদে মোহাম্মদ ইউসুফকে দুই বছর মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। বিসিএস-৮৬ ব্যাচের এই কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব থেকে অবসরে যান।
চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া প্রসঙ্গে কথা হয় প্রশাসনের তিনজন অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ার ফলে দুই বছরের জন্য ১২টি পদ ব্লক হয়ে গেছে। এতে যাঁরা সচিব হওয়ার যোগ্য তাঁরা হতে পারবেন না। তা ছাড়া প্রশাসনে গত এক দশকে সরকারি কাজে গতি বাড়াতে ই-নথিসহ (ডিজিটাল) নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের কাজে পরিবর্তন এসেছে। চুক্তিতে থাকা কর্মকর্তাদের নতুন করে আত্মস্থ করতে হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, একটা বয়সের পর মানুষের কর্মস্পৃহা থাকে না। সৃজনশীল চিন্তা করতে পারেন না। তাঁরা গতানুগতিক ধারায় চলেন। তাই গুরুত্বপূর্ণ পদে বয়োজ্যেষ্ঠদের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া ঠিক নয়।
এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কোর্ট কিপার পদে এ বি এম আমিনুল হককে এক বছর মেয়াদে চুক্তিতে নিয়োগ দেয়। পাশাপাশি সাংবাদিক তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়াকে এক বছরের জন্য ভারতে প্রেস শাখার প্রথম সচিব, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইকবাল আহমেদকে তিন বছর মেয়াদে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কমিশনার, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানকে তিন বছরের জন্য, এ কে এম শহিদুর রহমানকে এক বছর মেয়াদে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, এম আসাদুজ্জামানকে দুই বছরের জন্য বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান করা হয়।
উল্লেখ্য, স্থানীয় সরকার সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয় গত ৬ অক্টোবর। এক মাস পেরিয়ে গেলেও এ মন্ত্রণালয়ে সচিব নিয়োগ হয়নি। এ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম নিয়মিত (রুটিন) কাজ করে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সারা দেশে বিস্তৃত। তিন মাস ধরে গ্রামীণ রাস্তা সংস্কারের কাজ প্রায় স্থবির। সারা দেশে এক হাজার ৪১৬ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পলাতক। দেশে ৪ হাজার ৫৮০ ইউনিয়ন পরিষদ চলবে কীভাবে, সে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। এ ছাড়া সংস্কৃতি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের পদ খালি।
শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত আসছে দেরিতে। জাতীয়করণকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক কাজ বাকি। শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য প্রায় ১৫ হাজার। সেখানে বদলি কার্যক্রম চলছে ধীরগতিতে। প্রতিদিন সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে শিক্ষকদের ভিড় দেখা যায়। আগামী বছরের জানুয়ারিতে সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ ভিসি পদ পূরণ করা সম্ভব হলেও সহ-উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও একই চিত্র। এ মন্ত্রণালয়ে চিকিৎসকদের পদোন্নতি, স্বাস্থ্য উপকরণ কেনাকাটা, দরপত্র আহ্বানে দেরি হচ্ছে। এতে কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এর আগে ২০০১ ও ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল করে। যাতে প্রশাসনের কাজে স্থবিরতা দেখা না দেয়। কাজে গতি আসে। কিন্তু এবার অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল আনতে পারেনি।
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, বর্তমান সরকার যাঁদের চুক্তিতে সচিব পদে নিয়োগ দিচ্ছে, তাঁরা বিগত সরকারের সময়ে বঞ্চিত ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ ১০ বছর আগেই সচিব হতে পারতেন। যোগ্যতার ভিত্তিতে এখন কেউ কেউ সচিব হচ্ছেন। তবে দেখা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার ঢালাওভাবে চুক্তিতে সচিব নিয়োগ দিচ্ছে। এসব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ত্রুটিবিচ্যুতি ও নিয়মনীতির ঘাটতি রয়েছে। কারও কারও আত্মীয়স্বজন তদবিরে চুক্তিতে নিয়োগ পাচ্ছেন। সরকার যদি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে চায়, তাহলে একটা ফর্মুলা তৈরি করে সে অনুযায়ী দিতে পারে।