নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ কমানোর পক্ষে নয় বিএনপি
নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছরের জায়গায় চার বছর করার প্রস্তাব এসেছে বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে বক্তব্য দিয়েছেন, এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশির ভাগ দল বলছে, তারা প্রস্তাবিত চার বছর মেয়াদের সঙ্গে একমত নয়। তবে ছোট কিছু দল নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ এক বছর কমানোর পক্ষে রয়েছে।
বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, চার বছর পরপর নির্বাচন করা হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে। এ ছাড়া নির্বাচন করার জন্য বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয়ের বিষয়ও রয়েছে। তাঁরা আরও বলেন, দেশের রাজনীতিতে সহনশীলতার ঘাটতি রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এখনো অল্প সময়ের ব্যবধানে নির্বাচন করার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে তাঁরা মনে করেন।
নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ কমানোর দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের নয় বলে মনে করছে বড় দলগুলো। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল বলেন, চার বছর পরপর নির্বাচন হলে একটা নির্বাচিত সরকার কাজ করার সময় পাবে না। বাস্তবতা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পাঁচ বছর মেয়াদের পক্ষেই বিএনপির অবস্থান।
সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৯) ফাঁকে কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল–জাজিরাকে সাক্ষাৎকার দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত রোববার এই ভিডিও সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচার করেছে আল–জাজিরা। সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, সাধারণত নিয়মিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। মানুষ সরকারের মেয়াদ কম চায়। সংবিধানে নতুন করে চার বছরের প্রস্তাব করা হচ্ছে।
নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত ছয়টি কমিশন কাজ করছে। গণমাধ্যমসহ আর চারটি ক্ষেত্রে সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়েছে। অন্যদিকে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের নিয়ে বিএনপি যে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিল, সেই প্রস্তাবের সমর্থনে দলটি জনমত তৈরির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করছে। বিএনপিও সরকারের কমিশনগুলোর ছায়া হিসেবে তাদের দলের ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। দলটির কমিশনগুলোও ৩১ দফার ভিত্তিতে প্রস্তাব তৈরি করছে। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে।
বিএনপি ও এর মিত্ররা এবং জামায়াত এ পর্যন্ত সংস্কারের যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ কমানোর কোনো কথা বলেনি। তবে এসব দল সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এমন প্রস্তাব দিয়েছে।
বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যুগপৎ আন্দোলনে তাঁদের সঙ্গে ৫০টির বেশি দল ছিল। এসব কোনো দলই নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ চার বছর করার পক্ষে নয়। জনগণ ও নির্বাচিত সরকার ছাড়া এ ধরনের বিষয়ে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বলে তাঁরা মনে করেন।
জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর বহাল রাখার অবস্থানে রয়েছে। দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দলের সংস্কার প্রস্তাবে এ নিয়ে কিছু বলা হয়নি। তাঁরা মনে করেন, সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর থাকবে। কারণ, দেশের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনায় চার বছর পরপর নির্বাচন করা কঠিন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের উদ্যোগে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে চার বছর করার বিষয়ে নানাভাবে আলোচনায় এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা এই প্রথম এ ব্যাপারে কথা বলায় তা রাজনৈতিক অঙ্গনেও আলোচনার সৃষ্টি করেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন এ পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের প্রতিনিধি ও সংগঠনের সঙ্গে ১৫–১৬টি সভা করেছে। কমিশনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের বেশির ভাগই নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ চার বছর করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
বিএনপির শরিকদের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, নির্বাচিত সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ প্রতিষ্ঠিত একটা বিষয়। এই মেয়াদ কমানোর চিন্তা নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে। যুক্তরাজ্যকে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলা হয়। সেখানেও সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর রয়েছে।
গণতন্ত্র মঞ্চের আরেক নেতা জোনায়েদ সাকি বলেন, চার বছর মেয়াদের বিষয়ে তাঁরা এখনো কোনো আলোচনা করেননি। সংস্কারের প্রক্রিয়ায় এটি আলোচনায় এলে তখন তাঁরা অবস্থান ঠিক করবেন।
কিছু দল অবশ্য চার বছর মেয়াদের প্রস্তাবকে সমর্থন করছে। গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচিত সরকারগুলোও বিভিন্ন সময় স্বৈরাচার হয়েছে। সে জন্য মেয়াদ কমিয়ে চার বছর করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনেরও খুব একটা আপত্তি নেই। দলটির যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ চার বা পাঁচ বছর কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সরকার দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাবে, সেটিই তাঁরা প্রত্যাশা করেন।
বিএনপির মিত্র ১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন বলেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ কমানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।