বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪ , ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রকাশিত: ১১:৩৫, ২০ নভেম্বর ২০২৪

রাজনৈতিক দলগুলো যদি বলে, নির্বাচন দিয়ে দিন, নির্বাচন দিয়ে দেব:

রাজনৈতিক দলগুলো যদি বলে, নির্বাচন দিয়ে দিন, নির্বাচন দিয়ে দেব:

‘রাজনৈতিক দলগুলো যদি বলে, নির্বাচন দিয়ে দিন,  আমরা নির্বাচন দিয়ে দেব।’ সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস।

দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দূর্বলতা স্বীকার করে বলেন, যতটুকু আমাদের সাধ্যে কুলায় সেভাবেই চেষ্টা করছি। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতিটা বেশি হয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আসা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা।  সিন্ডিকেট বন্ধ করে দিলে সবকিছুই বন্ধ হয়ে যেতে পারে এরকম আশংকার কথা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ৬-৭ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা পাওয়ার কথা ছিল সেটা দ্রুত পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।  

অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে জনমনে সে প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা স্বাভাবিক। আমরা তো এ কাজের মানুষ না। আমাদের তারাই পছন্দ করে নিয়ে আসছে। কাজেই আমরা যতদূর পারি, ততদূর করি। ভুল-ত্রুটি হবে স্বাভাবিক। ভুল-ত্রুটির মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে। যতটুকু আমাদের সাধ্যে কুলায় সেভাবেই চেষ্টা করছি। আর যেগুলো অসম্পূর্ণতা আছে, আমরা চেষ্টা করি কীভাবে সম্পূর্ণ করব।’ 

সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ধরে নিচ্ছি জানুয়ারির মধ্যে রিপোর্ট এসে যাবে। এগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে দেব যে বলুন, কোনটি আপনাদের পছন্দ? যেটি আপনাদের পছন্দ, যেটি করতে চান, সেটি করব। আর যেগুলো অপছন্দ বা কেউ একমত হতে পারছে না; সেগুলো বাদ রাখব। কাজেই এটা তাদের নেগোসিয়েশন বা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার বিষয়। আমরা সাহায্য করব তাদের আলাপ-আলোচনায়।’ 

তিনি বলেন, ‘আমরা ধরে নিচ্ছি এখানে ১০০টা প্রস্তাব আছে। যেখানে বলা আছে এটি করতে হবে, ওটি করতে হবে। ধরা যাক, ১০০টির মধ্যে ১০টির ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো আপত্তি নেই। আর দশটি একটু এদিক-ওদিক বদল করে দিলে হতে পারে। আমি আন্দাজ করছি। অথবা যদি বলে যে, এগুলোর কোনোটিরই দরকার নেই, তাড়াতাড়ি নির্বাচন দেন। এগুলো আমরা করব। আপনাদের এসবের মধ্যে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। রিপোর্ট লিখেছেন, এখন আমাদের কাছে আসবে। আমরা দেখবো। এরকমও হতে পারে। যদি বলে যে নির্বাচন দিয়ে দিন, তাহলে আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। আমরা নির্বাচন দিয়ে দেব। সেজন্যই বলছি, আমি তো বলতে পারছি না, বলতে হবে তাদেরকে।’

আল জাজিরাকে দেয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকার চার বছরের কম সময় থাকতে পারে- এরকম একটি বক্তব্য প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ওখানে আমার বক্তব্য যেটি আল জাজিরায় ছাপা হয়েছে, সেটি বোধ হয় আমার অফিস থেকে বলা হয়েছে। প্রসঙ্গটি নির্বাচন নিয়ে কথা ছিল না। এটি ছিল পার্লামেন্টের চার বছর নিয়ে আলোচনা। 
আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল—এই যে সংস্কার করবেন, সেগুলো কী কী হতে পারে? উত্তরে আমি বলেছিলাম বহু হতে পারে; বহু রকমের ইস্যু আছে। যেমন কেউ বলে যে প্রত্যেক সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছরের জায়গায় চার বছর করুন। তখনই চার বছরের প্রশ্নটি এল। সে সময় আবার প্রশ্ন করা হয় যে তাহলে আপনারা কী চার বছর থাকবেন? কথাটি ছিল পার্লামেন্টের, এখন প্রশ্ন করে ফেলল আপনারা কী চার বছর থাকবেন? ওই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছি, না, না। অনেক কম। এই অনেক কমটাই এসে বলছে চার বছর।’ 

তাহলে কি আল জাজিরা আপনার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে? এরকম প্রশ্নের জবাবে অবশ্য প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আল জাজিরা ভুলভাবে উপস্থাপন করেনি। তারা ঠিকই দিয়েছে। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম সুন্দর রিপোর্ট করেছে। কিন্তু অন্য অনেক কাগজে চার বছর লাগবে উল্লেখ করেছে। আরে চার বছর ওদের (উপদেষ্টাদের) তো ধরেবেঁধে রাখতে পারবেন না। যাদের নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়, উপদেষ্টামণ্ডলী, তারাই বলবে, আজই আমাদের ছেড়ে দিন। আমি কী করে চলব? এ বেতনে আমার ছেলের বেতন দিতে পারছি না। যত তাড়াতাড়ি পারেন নির্বাচন দিয়ে দিন। আমরা চলে যাই। কাজেই আমাদের উদ্দেশ্য হলো যে তাড়াতাড়ি যাওয়া। আমরা চার বছর বললে তো লোক এখনই বের হয়ে চলে যাবে। একজন-দুজন না, আমাদের কয়েকজন আছে যারা বলেন, আমাদের ছেড়ে দেন। আর কতদিন আমাদের রাখবেন?’

দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, ‘ছয়টি বন্যা গেছে। সে সময় ফসল নষ্ট হয়েছে, সবজি নষ্ট হয়েছে। সেটির ধকল সহ্য করতে হয়েছে। তারপর যেগুলো আমদানি করা হচ্ছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে মুদ্রার বিনিময় হারে পরিবর্তন এসেছে। এ টাকা ডলারে পরিবর্তন হয়ে সেখানে খরচ বেশি হচ্ছে। এজন্যই মূল্যস্ফীতিটা বেশি হয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।’

ব্যাংক খাতের সংস্কার প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের এখন পলিসি হলো ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। একটি ব্যাংক ফেল করা আরম্ভ করলে তারপর একের পর এক ফেল করা শুরু করবে। এটি ভয়ংকর জিনিস হবে। কাজেই আমাদের তো একটি উপায় বেছে নিতে হবে। পলিসি বলতে, একটু সহ্য করি সবাই মিলে। যাতে করে ব্যাংক বাঁচে এবং পুরো সিস্টেম ফাংশন করতে আরম্ভ করে।’

পাচারকৃত অর্থ ফেরৎ আনা প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, ‘সবাই বলছে কিন্তু টাকা ফেরত আসছে না। ফেরত আসবে কিনা জানি না। আশা করি যেন আমরা কাজটা শুরু করে দিয়ে যেতে পারি। এ প্রক্রিয়া বড় জটিল প্রক্রিয়া। আইনি প্রক্রিয়া। কেউ কারো টাকা ছাড়তে চায় না। যে ব্যাংকে টাকা গেছে সে ব্যাংক টাকা রাখার জন্য আইনজীবীদের লাগিয়ে রেখেছে। আর যে মালিক নিয়ে গেছে, সেও আইনজীবী লাগিয়েছে। এটা আইনের লড়াই হবে। সাক্ষী-প্রমাণের লড়াই হবে যে কে পাবে আর কে পাবে না। যত রকমের প্রতিষ্ঠান আমাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে, সবাই আশ্বাস দিচ্ছে। বলছে সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এটা করা সম্ভব আংশিকভাবে, পুরো টাকাটা আসবে না।’

শ্বেতহস্তী প্রকল্পগুলো নিয়ে কী করবেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা চিন্তার বিষয় যে এগুলো বন্ধ করে দিলে ভালো হবে, নাকি চালিয়ে রেখে এর থেকে আদায় করার চেষ্টা করা হবে? বহু বড় বড় প্রতিষ্ঠান বেতন দিচ্ছে না। এটা বিক্রি হলে আইনের প্রশ্ন আছে। কার জিনিস আপনি বিক্রি করছেন? সব জটিলতার মধ্যে আটকে আছে। যেমন বেক্সিমকো একটা কোম্পানি, বেতন দিতে পারছে না মাসের পর মাস। তার তহবিলে টাকা আছে এমনটা তার কাগজে বলা হচ্ছে। সে বলছে, আমার টাকা নেই। ব্যাংককে বলা হচ্ছে টাকা ধার দিতে, ব্যাংক বলছে আমি কিসের ওপর টাকা ধার দেব? তার তো কিছু নেই, ধার দেব কিসে?’ 

বিগত সরকারের সিন্ডিকেট বা অলিগার্কদের কর্তৃত্ব ভাঙতে পেরেছে কী না জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা আমাদের ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এটা মস্ত বড় জিনিস। ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে। সেটা তো মানুষের চোখে পড়ে না। দৈনন্দিন প্রয়োজনে আমি আটকে যাচ্ছি। সে যদি আমদানি না করে, তাহলে আমি ভোজ্যতেল পাচ্ছি না। সে যদি চিনি আমদানি না করে, আমি চিনি পাচ্ছি না। কাজেই তাদের চালু রেখে চিনি আসবে? নাকি বন্ধ করে দিয়ে চিনির সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হবে? আরেকজনকে তো চিনি আনতে হবে, কে চিনি আনবে? কাজেই এগুলো দোটানার বিষয় যে তাকে কতদূর সুযোগ দেবেন, বা কতদূর তাকে বন্ধ করবেন। ওকে বন্ধ করে দিলে আমাদের তো সবকিছু বন্ধ।’

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসার পর ড. ইউনূস বলেছিলেন ৬-৭ বিলিয়ন ডলারের মতো সহায়তা আসতে পারে। কবে নাগাদ এই অর্থ বা বাজেটারি সহায়তা বাংলাদেশে আসবে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে এগুলোয় সময় অনেক লাগে। আমরা তাদের কাছে বারবার বলেছি যে এত সময় নিলে তো এ সরকার আর কাজ করতে পারবে না। তোমরা চাচ্ছ যে এ সরকারকে সমর্থন করবে, তাদের কাজকে এগোতে দেবে। আমরা তৈরি আছি এ জিনিসগুলো করে দেয়ার জন্য। তারা বলছে আমরা তাড়াতাড়ি দেব। এখন তাড়াতাড়ি বলতে কত তাড়াতাড়ি? আপনারা যেমন কবে নির্বাচন দেবেন বলে আমাদের পেছনে লেগেছেন, আমরাও তাদের পেছনে লেগেছি যে কবে দেবে বলো।’

সর্বশেষ

জনপ্রিয়