‘সব পুড়িয়ে ফেলার’ হুমকি, ভেস্তে গেল লালনমেলার আয়োজন
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় মরমি সাধক লালন সাঁই স্মরণে ‘মহতি সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা’র আয়োজন বন্ধের হুমকি আসার পর অনুষ্ঠানস্থলের ত্রিপল খুলে ফেলা হয়েছে। ফিরে গেছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা লালনভক্তরা। লালনের তত্ত্বগানে যে স্থান মুখরিত হওয়ার কথা ছিল, সেখানে এখান সুনশান নিরবতা।
কোলাহলমুক্ত ছায়াসুবিনিড় সদরের কাশীপুর ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামে ‘মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি’ প্রাঙ্গণে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে ‘গুরুকর্মের’ মধ্য দিয়ে দুদিনের এই আয়োজন শুরুর কথা ছিল।
কিন্তু স্থানীয় ‘তৌহিদী জনতা’র বিক্ষোভ, হুমকির মুখে সেটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, “লালন মেলার জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন আয়োজকরা৷ অন্যদিকে লালন মেলা বন্ধে একটি দল স্মারকলিপি দিয়েছে৷ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় লালন মেলার আয়োজন করতে নিষেধ করা হয়েছে৷”
শুক্রবার দুপুরে ‘মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি’ প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা গেল, চারদিকে চাপা আতঙ্কের পরিবেশ। সেখানে মাটিতে কয়েকটি বাঁশ পুঁতে রাখা আছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে টানানো ত্রিপল নেই৷ আশ্রম প্রাঙ্গণে ‘মলিন মুখে’ পায়চারি করছিলেন সাধুসঙ্গের আয়োজক ফকির শাহ জালাল৷ অদূরে একটি চায়ের দোকানে দুজন পুলিশ সদস্যকে বসে থাকতে দেখা যায়।
লালনের এ সংগীত চর্চায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লালনভক্তদের পাশাপাশি গান পরিবেশনের জন্য বাউল শিল্পী শফি মণ্ডলকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
ফকির শাহ জালাল বলেন, “সকালে ত্রিপলটি খুলে ফেলা হয়েছে৷ দূর-দূরান্ত থেকে আসা লালনভক্তদের অনেকেই ফিরে গেছেন; বাকিরাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা হবে না৷ এখানে কারো জড়ো হওয়া ও গান-বাজনা নিয়ে প্রশাসনের নিষেধ রয়েছে৷”
লালন মেলার এ আয়োজন নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরেই আতঙ্কে ছিলেন ভক্তরা৷ গত শুক্রবার এই লালন মেলাকে ‘ঈমান বিধ্বংসী’ হিসেবে বর্ণনা করে তা বন্ধের দাবিতে ‘কাশীপুর ইউনিয়নের সর্বস্তরের তৌহিদী জনতার ব্যানারে নরসিংহপুর গ্রামে বিক্ষোভ মিছিল করে শতাধিক মানুষ৷
পরে মুক্তিধাম আশ্রমের অদূরে স্থানীয় একটি ঈদগাহে জড়ো হন তারা। সেখানে লালন মেলা বন্ধের ‘হুমকি’ দিয়ে বক্তব্য দেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আব্দুল আউয়াল৷
‘তৌহিদী জনতার’ পক্ষে কয়েকজন গত সোমবার জেলা প্রশাসকের কাছে এ মেলা বন্ধের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপিও দেন৷
অন্যদিকে মেলা বন্ধের চেষ্টার প্রতিবাদ জানিয়ে বুধবার মানববন্ধনের আয়োজন করে মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডোমি। মানববন্ধনে সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মীরা অংশ নেন৷ লালন মেলা বন্ধের হুমকির প্রতিবাদ ও নিন্দা জানায় নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটও৷
তারপরও সাধুসঙ্গ ও লালন মেলার আয়োজন করার আনুষ্ঠানিক অনুমতি মেলেনি জেলা প্রশাসন থেকে।নিজেদের প্রাঙ্গণে ‘সীমিত পরিসরে’ আয়োজন করতে চাইলেও ‘প্রশাসনিক চাপে’ তা পারেননি বলে ফকির শাহ জালালের ভাষ্য।
তিনি বলেন, “কয়বার গেছি ডিসি সাহেবের কাছে, এসপি সাহেবের কাছে৷ পারমিশন দিল না৷ একটা মাইকও লাগাই নাই৷ ত্রিপল টানাইয়া নিজেরা সাঁইজির ভাবচর্চা করার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু সকালে কয়েকজন আইসা ‘সবকিছু পুইড়া ফেলানোর’ হুমকি দিল৷
ভয়ে ডেকোরেটরের লোকজন সবকিছু খুইলা নিছে গা৷ পুলিশ-প্রশাসনের লোকজনও আশ্রমে আসা লোকজনকে চইলা যাইতে বললেন৷”
লালনভক্ত অনেকে ‘আতঙ্কে’ চলে গেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “অতিথিদের রান্নার আয়োজন করছিলাম৷ খাইতেও পারলেন না, বয়স্ক মানুষদের নিরাপত্তার কথা ভাইবা পাঠাইয়া দিলাম৷ নিজের ঘরেও যে মানুষে বন্দি থাকে তেমনি বন্দি আছি৷ মনের ভেতর খুব অস্বস্তি লাগতেছে৷”
লালন মেলায় অংশ নিতে কুমিল্লা থেকে এসেছিলেন ৫৭ বছর বয়সী লালনভক্ত কামাল উদ্দিন। প্রতিবছর এ আয়োজনে অংশ নিলেও এবার ‘তৌহিদী জনতার’ হুমকি আর প্রশাসনিক ‘নিষেধে’ অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ব্যাগ গুছিয়ে রওয়ানা হচ্ছিলেন৷
তিনি বলেন, “সাঁইজির নামে দুইডা গান করতে আইছিলাম৷ সাধারণ গানটাও গাইতে দিব না, থাকতে মন চাইতেছে না।”
আশ্রমের সামনের খালি জায়দায় দাঁড়িয়ে দুটি পিকআপ ভ্যানে মালামাল তুলছিলেন রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। লালন মেলা উপলক্ষে বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, নৌকা নিয়ে এসেছিলেন কুমিল্লার হোমনার এ বাসিন্দা৷ মেলা বন্ধের ঘোষণায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।
রফিকুল বলেন, “১৮ হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়া এইসব আনছি৷ যাইবার লাগতেছে ২২ হাজার টাকা৷ পাঁচদিন থাকার কথা ভাবছিলাম৷ সবগুলা টাকাই জলে৷ টাকাও তো আর সব না। গ্যাছে ১৯ বছরে এইরম হয়রানি হইলাম না হইলে কোনোদিন৷”
আশ্রমের সামনে ফতুল্লা মডেল থানার এএসআই জাহাঙ্গীর বলেন, “সাধুসঙ্গ ও লালন মেলার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন। প্রশাসনিকভাবেও এ মেলার অনুমতি দেয়নি৷ তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আশ্রমের সামনে অবস্থান করছি৷”
সাধুসঙ্গ ও লালন মেলার আয়োজন পণ্ড হওয়ায় লালনভক্তরা যেমন একদিকে মর্মাহত, তেমনি তারা হামলার আতঙ্কেও আছেন৷
আশ্রমের সামনের বেদীতে বসে থাকা ৬৫ বছর বয়সী মনোয়ারা বেগম একজনকে বলছিলেন, “মাইক বাজাইলে সমস্যা, বক্স (লাউডস্পিকার) বাজাইলে সমস্যা৷ তয় বুঝলা আনোয়ার, রাইতের খাওনডা খাইয়া তুই ডেক বাজাবি, আমি পাতিল আর চামুচ বাজামু৷ তাইলেও কি হামলা দিব রে?”
এ বিষয়ে কথা বলতে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও জেলা কমিটির সাবেক আমির আব্দুল আউয়ালকে একাধিকবার ফোন করলেও তার সাড়া মেলেনি।