তিন মাস কোনো বেতন নেই, রেশন নেই, ‘না খেয়ে কত অপেক্ষা করা যায়’: ক্ষুদ্ধ চা শ্রমিকরা
তিন মাস অর্থাৎ ১২ সপ্তাহ ধরে তার কোনো বেতন নেই, রেশন নেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিকদের। চরম দূর্বিপাকে দিন কাটাচ্ছেন তারা। ক্ষুদ্ধ চা শ্রমিকরা বলছেন, এর আগে কখনো এতোদিন ধরে বেতন বকেয়া থাকেনি। আমরা দিন আইন দিন খাই। না খেয়ে আর কত অপেক্ষা করা যায়?
লাক্কাতুরা চা বাগানের ঋষি গোয়ালা ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন। থাকেন বাগানের শ্রমিক লাইন কলোনিতে। চার সদস্যের পরিবার। কম হোক, বেশি হোক বাগানে কাজ করেই তিনি চলেন।
কিন্তু তিন মাস অর্থাৎ ১২ সপ্তাহ ধরে তার কোনো বেতন নেই, রেশন নেই। ফলে পরিবারের মুখে খাবার দিতে এখন ঋষিকে বাগানের বাইরে কাজে যেতে হচ্ছে; যার পারিশ্রমিক দিনে বড়জোড় একশ থেকে দেড়শ টাকা। সেটাও সবদিন মেলে না।
বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি অনেকবার গিয়েছেন, কবে বেতন হবে- সেটি জানতে। কর্তৃপক্ষ বলেছে, অপেক্ষা করতে। কিন্তু ‘দিন আনি দিন খাই’ শ্রমিক ঋষি গোয়ালার প্রশ্ন- না খেয়ে একজন মানুষ কতদিন অপেক্ষা করতে পারে?
শুক্রবার ৫৫ বছর বয়সী ঋষি গোয়ালা হতাশা আর ক্ষোভ নিয়ে বলছিলেন, “এত বছর ধরে চা বাগানে কাজ করছি। এর আগে এ রকম টানা এত সপ্তাহ বেতন বন্ধ থাকেনি চা শ্রমিকদের। আমাদের বেতন কবে হবে তাও জানানো হচ্ছে না। শুধু বলা হচ্ছে, অপেক্ষা করতে। আর কত খেয়ে না খেয়ে অপেক্ষা করব। টাকার অভাবে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারছি না। আমাদের অবস্থা দেখার কি কেউ নাই?”
পরিবার চালানোর বিষয়ে ঋষি গোয়ালা বলেন, “কোনো দিন বাহিরে কাজ করে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ইনকাম করি। তবে বাহিরে সবদিন কাজ মিলে না। এভাবে চলছে দিন। এক বেলা ভাত খেয়ে, অন্য বেলা আঠার রুটি খেয়ে চলছি। ডিসি সাহেব বলেছেন আমাদের বেতনের ব্যবস্থা করবেন; তাই আমরা কোনো কর্মসূচি করছি না।’’
এ সময় ঋষি গোয়ালার পাশে থাকা অমিরন গোয়ালা জানান, তিনি ২৪ বছর ধরে বাগানে কাজ করছেন। এ রকম সমস্যায় আর পড়তে হয়নি শ্রমিকদের। তিন মাস হয়ে গেছে তাদের বেতন নেই। সরকারি সব বাগানে এই অবস্থা চলছে।
অমিরন গোয়ালা বলেন, “বাগান থেকে লাকড়ি আর লতা তুলে বিক্রি করে দিন যাচ্ছে আমাদের। লাক্কাতুরা চা বাগানে ১২৭০ জন শ্রমিক রয়েছেন। প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবার আছে। আমাদের ডিসি অফিস থেকে প্রথমে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছিল। দুই বা তিন সপ্তাহ আগে ডিসি অফিস থেকে ১০ কেজি চাল, আলু, তেল, ডাল, লবণ পেয়েছিলাম। সিলেটের জেলা প্রশাসক বলেছেন, আমাদের বেতনের বিষয়ে তিনি যোগাযোগ করছেন। তাই আমরা আন্দোলন বন্ধ রেখেছি। এই তিন মাসে আর কোনো সাহায্য পায়নি চা শ্রমিকরা। শ্রমিকদের বেতন কবে হবে তার কোনো খবর নাই।’’
শুক্রবার বিকালে সিলেট নগরীর লাক্কাতুরা চা বাগান এলাকায় নিজেদের দুঃখ-কষ্টের কথা এভাবেই তুলে ধরেন বেতন বন্ধ থাকা চা শ্রমিকরা।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) অধীন চা বাগানের শ্রমিকদের বেতন তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। বকেয়া বেতনের দাবিতে এনটিসি মালিকানাধীন সিলেটের লাক্কাতুরা, দলদলি ও কেওয়াছড়া চা বাগানে শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করলেও কোনো সুফল পানিনি।
এনটিসির আওতাধীন সিলেট বিভাগের ১২টি চা বাগানেই বেতন বকেয়া পড়েছে বলে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা জানান।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ন্যাশনাল টি কোম্পানির ফাঁড়ি বাগানসহ ১৬টি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে প্রায় ১৭ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের উপর নির্ভর করে আরও ৩০ হাজার মানুষের ভরণপোষণ। ন্যাশনাল টি কোম্পানির আওতাধীন সিলেট বিভাগের আওতাধীন সব চা বাগানেই বেতন বকেয়া পড়েছে।
লাক্কাতুরা চা বাগানের নারী শ্রমিক অষ্টমী লোহার বলেন, তিন মাস ধরে বেতন বন্ধ থাকায় ১১ সদস্যের পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন চলছে। পরিবারের তিনজন বাগানে কাজ করে সংসার চালাতেন। বেতন বন্ধ থাকায় দিন যাচ্ছে খেয়ে না খেয়ে।
তিনি বলেন, “বাগান থেকে তুলে আনা কচু আর শাক দিয়ে খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে পারছি না। খানি খাওয়াতে পারছি না।”
নারী শ্রমিক সুনকা মোদী বলেন, “এক বেলা ভাত খেলে, দ্বিতীয় বেলা রুটি খাই। ভাতের সঙ্গে আলু বর্তা, চাটনি দিয়ে খাই। বাগানের কচু সিদ্ধ করে খাচ্ছি। এভাবে দিন যাচ্ছে। বাহিরে কাজ করে তা দিয়ে চলছি। আমরা তো বেতনের জন্য কান্না করছি, কথা বলতেছি, কিন্তু আমাদের কথা তো কেউ শুনে না। আর কত লড়ব। দুঃখের কথা কাকে বলব।”
কিশোরী মোহনা গোয়ালা বলেন, তার ভাই বাগানে কাজ করে সংসার চালাত। পরিবারে চারজন রয়েছেন। তার বাবা নেই। বাগানে বেতন বন্ধ থাকায় তাদের কষ্ট হচ্ছে। বেতন বন্ধ থাকলে কিভাবে খাওয়া-দাওয়া হবে সেই প্রশ্ন তার।
সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি শিতু লোহার বলেন, “বেতনের কোনো খবর এখন পাইনি। যে যেভাবে পারছে সেভাবে চলছে চা শ্রমিকেরা। আমরা খুব অসুবিধায় রয়েছি। শনিবার পর্যন্ত আমরা বেতনের জন্য অপেক্ষা করব। রোববার থেকে বকেয়া বেতনের দাবিতে ফের রাস্তায় নেমে যাব আমরা।’’
দলদলি চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি মিন্টু দাস বলেন, “তিন মাস হয়ে যাচ্ছে বেতন দিচ্ছে না। কোম্পানি কোনো কিছু জানাচ্ছে না। শ্রমিকরা খুব কষ্টে আছে; খেয়ে না না খেয়ে দিন কাটছে শ্রমিকদের।’’
বাংলাদেশ চা শ্রমক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা বলেন, “শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ১১ সপ্তাহ পার হয়ে ১২ সপ্তাহে পড়বে শনিবার। এখন পর্যন্ত কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কিছু বলছে না। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ শুরু থেকে বলেই যাচ্ছে, বেতন হয়ে যাবে। কবে হবে তা বলছে না।এবারই প্রথম এনটিসি মালিকানাধীন বাগানগুলো এত দিনের বেতন বকেয়া পড়েছে। এর আগে এ রকম হয়নি।”
বকেয়া বেতনের বিষয়ে ন্যাশনাল টি কোম্পানির লাক্কাতুরা চা বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহমুদ হাসান বলেন, “কোম্পানি কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করেছেন; তবে এখনও কোনো সমাধান হয়নি। আশা করছি, দ্রুত কিছু হবে।”
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, “এ বিষয়ে বোর্ড গঠন হয়েছে। শ্রমিকদের বেতনের বিষয়টি বর্তমানে মূলধন সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।”