এখন দখল-চাঁদাবাজির অভিযোগ বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা অনিয়ম অব্যাহত রয়েছে। অথচ যে কোনো বিশৃঙ্খলা রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। তবু থামছে না দখল-চাঁদাবাজি।
জানা গেছে, ভোলার চরফ্যাসন উপজেলায় সরকারি অর্থায়নে নির্মিত নীলিমা আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকা ২০ পরিবারের ঘর ভেঙে উচ্ছেদ করেছেন যুবদল নেতা মো. মমিন। নিরুপায় হয়ে স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। গত ১৮ নভেম্বর রাতে চরফ্যাসন পৌরসভা ২ নম্বর ওয়ার্ডের নীলিমা আদর্শ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। মো. মমিন চরফ্যাসন পৌর যুবদলের সদস্য এবং পৌরসভা ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইসলাম মাস্টারের ছেলে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে আশ্রিত ২০ পরিবারকে জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হুমকি দিচ্ছিলেন স্থানীয় যুবদলের নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে গত রবি ও সোমবার রাতে ভাঙচুর করে লুটে নেওয়া হয় দরজা ও জানালা এবং টিনের চাল। এতে অসহায় পরিবারগুলোকে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে।
যুবদল নেতা মো. মমিনের দাবি, এই জমি তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে রেকর্ডভুক্ত। সেটি দখল করে আওয়ামী লীগের সময় হতদরিদ্রদের জন্য ঘর দেওয়া হয়। অসহায় ২০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়নি, তারা স্বেচ্ছায় ঘর ভেঙে নিয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
এদেকে জামালপুর বিএনপির একাধিক নেতাসহ এলাকাবাসী জানান, শেখ হাসিনার পতনের পর জামালপুরে দখল আর চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ ওয়ারেস আলী মামুন। অভিযোগ আছে, একসময় যুবদল নেতাকে হত্যার মাধ্যমে হঠাৎ লাইমলাইটে আসা মামুন দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠেন। জামালপুর পৌরসভার মেয়রও নির্বাচিত হন। সময়ের পরিবর্তনে তিনি এখন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের আমলেও তিনি বেশ আরামেই ছিলেন।
জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে মামুনের গভীর সখ্য রয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর ফারুক আহমেদ চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসা দখল এবং চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নেন মামুন। ৫ আগস্টের পর সবার আগে তিনি নিয়ন্ত্রণে নেন ব্রহ্মপুত্রের বালু ব্যবসা। আওয়ামী লীগের পতনের দিন তার ভাই জামালপুর শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ মাসুদের নেতৃত্বে পৌর শহরের বগাবাইদ এলাকায় অবস্থিত আলেয়া গার্ডেনে ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়। একই সঙ্গে আলেয়া গার্ডেনের পাশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বাবুলের ডেইরি ফার্ম থেকে ২০টির গরু এবং মামুনের অত্যন্ত বিশ্বস্ত মৎস্যজীবী দলের হালিমের নেতৃত্বে প্রায় ১ কোটি টাকার মাছ লুটপাট করার অভিযোগ উঠেছে। একই দিনে মামুনের সহযোগিতায় জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন কর্নেল ও শহর বিএনপির সহসভাপতি তরুণ হাছান কাজলের নেতৃত্বে জাহেদা শফির মহিলা কলেজের প্রায় ৩০ লাখ টাকার নির্মাণসামগ্রী লুটপাট করা হয়। মামুনের ভাই শাহ মাসুদের নিয়ন্ত্রণে শহরের ১০, ১১ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়। চাঁদা না দেওয়ায় ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জীবনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালানো হয়।
এ ছাড়া গত ৭ আগস্ট মামুন আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম জার্নিসকে বাসমালিক সমিতির সভাপতি করেন এবং অনুগত ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা সাখওয়াত হোসেন শুভকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, পরবর্তী সময়ে সভাপতি জার্নিসকে সরিয়ে মামুন নিজে সভাপতির পদ দখল করবেন।
এ ছাড়া শ্রমিক লীগের যুগ্ম সম্পাদক ছানুয়ার হোসেন ছানুকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যর বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে যাদের কমিটিতে রাখা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে মামুনের বিরুদ্ধে। ব্রহ্মপুত্রের বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দখল বাণিজ্য শুরু হয়। মামুনের পছন্দের বিএনপি-যুবদলের নেতাকর্মীরা তাকে সহযোগিতা করছেন।
শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন সরকারি অফিসের টেন্ডারবাজির মহড়া দেওয়ার অভিযোগও পুরোনো। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ চৌধুরীর চলমান প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন ওয়ারেস আলী মামুন। গত ১৭ বছর জামালপুরের একক নিয়ন্ত্রক ফারুক আহমেদ চৌধুরীর পরিবহন ব্যবসাসহ সব ব্যবসা এখন মামুনের নিয়ন্ত্রণে। মামলা বাণিজ্যের অভিযোগের পাশাপাশি জামিন বাণিজ্যের অভিযোগও আছে। তার একাধিক আস্থাভাজন অ্যাডভোকেটকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীদের জামিনে মুক্তি করে দিচ্ছেন মামুন।
সরকারি দপ্তরের ঠিকাদারিসহ সব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন মামুনের বিশ্বস্ত ভাই শাহ মাসুদ, জেলা যুবদলের আহ্বায়ক সজীব খান এবং মৎস্যজীবী দলের হালিম। আওয়ামী লীগ আমলের সব চলমান প্রকল্প মামুনের পছন্দসই নেতারা দখলে নিয়েছেন।
জানা গেছে, মৎস্যজীবী দলের নেতা হালিম গণপূর্ত বিভাগ নিয়ন্ত্রণ নিতে গেলে চারপাশে সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ ট্রাকমালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণে মামুনের আস্থাভাজন যুবদল নেতা মিজানুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছে। পরিবহন খাত, সব সরকারি দপ্তরের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, চলমান প্রকল্পের কাজ দখলসহ চাঁদাবাজিতে এরই মধ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওয়ারেস আলী মামুন।
জামালপুর খাদ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, মামুন সরাসরি অফিসে এসেছিলেন খাদ্য বিভাগের সব কাজ যেন তাকে জানিয়ে করা হয়। জনস্বাস্থ্য, সড়ক বিভাগ, গণপূর্ত, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সব সরকারি দপ্তর পুরোটা মামুনের একক নিয়ন্ত্রণে। বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে, ৫ আগস্টের পর পরিবহন খাতসহ চাঁদাবাজির কোটি কোটি টাকা এরই মধ্যে মামুন পকেটে ভরেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মামুন বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, তার সঙ্গে আমার ন্যূনতম সম্পৃক্ততা নেই। কোনো দখলের সঙ্গে আমি নেই। আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদের সাড়ে তিনশ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ নেওয়ার বিষয়ে বলেন, আমরা ১৭ বছর তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি কি তার কাজ নেওয়ার জন্য? অভিযোগের প্রমাণ দেন। নিজের ভাই শাহ মাসুদকে দিয়ে বিভিন্ন দখল ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে মামুন বলেন, অভিযোগ থাকতেই পারে। কারণ আমার প্রতিপক্ষ আছে, দলের মধ্যে গ্রুপিং আছে। আমার ভাইকে দিয়ে কোথায় কোন কাজ নিয়েছি? কী কাজ করাচ্ছি, সেগুলোর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেন। ডেইরি ফার্ম থেকে গরু এবং মাছ লুটের কোনো ঘটনায় বিএনপির কেউ জড়িত নন বলে তিনি দাবি করেন। অন্যান্য অভিযুক্ত বলেন, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে। তারা কোনো দখল-চাঁদাবাজিতে জড়িত নন।
অন্যদিকে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব ও মেদেনীমণ্ডল ইউনিয়নের সভাপতি লুৎফর রহমান পাভেল মোল্লার বিরুদ্ধে নিজদলীয় কর্মীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে মেদেনীমণ্ডল ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস দখল, পদ্মা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, মাওয়া মাছের বাজারে চাঁদাবাজি, অটোরিকশা-মিশুক ও সিএনজি স্ট্যান্ডের চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। তার ছত্রছায়ায় যুবদলের একাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও মাছ ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তার কর্মকাণ্ডে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ এবং বিব্রত।
রংপুরের মিঠাপুকুরের হেলেঞ্চায় বন বিভাগ থেকে লিজ নেওয়া জমিতে কৃষকের রোপণকৃত কলাগাছ ও ইউক্যালিপটাস গাছ কাটার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় বিএনপির এক নেতাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। এমনকি কৃষকের জমি-সংলগ্ন হেলেঞ্চা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের ২০টি কাঁঠালগাছও কেটে নিয়েছে তারা। গত মঙ্গলবার এ ঘটনা ঘটে। উপজেলার বালুয়া মাসিমপুর ইউনিয়নের হেলেঞ্চা গ্রামের কৃষক মো. আল রাব্বী ৬ বছর আগে হেলেঞ্চা বন বিট থেকে ৩৬ শতাংশ জমি ১০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে ২০০ কলাগাছ, ২০টি কাঁঠালগাছ, ৪৫টি ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণ করেন। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গত সোম ও মঙ্গলবার রাতে ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. শাহআলমের নেতৃত্বে মনোয়ার মুন্সি, সুলতান, হাবিবুর, ডা. লাবিব, মেজবাহুলসহ কয়েকজন বিভিন্ন সময় গাছগুলো কেটে ফেলেন। এতে ৫ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে।
অভিযোগ বিষয়ে শাহআলম বলেন, আপনার যা লেখার আছে লেখেন। আমার তাতে কিছু যায়-আসে না। আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিপদ আছে। বন বিট কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানান, ছয় বছর আগে কৃষক আল রাব্বীকে ১০ বছরের জন্য ৩৬ শতাংশ জমি লিজ দেওয়া হয়েছিল। সেখানে গাছগুলো লাগিয়েছিলেন তিনি। জানতে পারলাম গাছগুলো কে বা কারা রাতের অন্ধকারে কেটে নিয়ে গেছে। মিঠাপুকুর থানার ওসি আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ঘটনার বিষয়ে শুনেছি। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র বর্মণ বলেছেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত। যে-ই জড়িত থাকুক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।