শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ , ১২ পৌষ ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রকাশিত: ১২:০০, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১২:০০, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

গার্মেন্ট খাতে বিপর্যয়, তৈরি পোশাকের দাম কমাচ্ছেন বিদেশি ক্রেতারা

গার্মেন্ট খাতে বিপর্যয়, তৈরি পোশাকের দাম কমাচ্ছেন বিদেশি ক্রেতারা

শ্রমিক অসন্তোষের পাশাপাশি বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের পোশাক খাত এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় এই খাতের উদ্যোক্তারা মুনাফা করতে পারছেন না। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রেতারা রফতানি হওয়া বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমিয়েছেন প্রায় ৫ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম প্রায় ৮ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে।

তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম কমে যাওয়ার কারণে তারা উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। উদ্বিগ্ন হওয়ার একাধিক কারণ উল্লেখ করে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পোশাকের দাম বাড়ানো না হলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। নাম প্রকাশ না করে একজন গার্মেন্টস মালিক বলেন, খরচ বেড়ে যাওয়ায় নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন এবং ৯ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়া তার জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের বেতন দিতে গিয়েই তিনি হিমশিম খাচ্ছেন।

এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক সংকটে পড়েছে বেশিরভাগ গার্মেন্ট কারখানা এবং কিছু কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। বিশেষ করে অতীতে ভালো অবস্থানে থাকা কারখানাগুলোও এখন সংকটে পড়েছে। এই খাতের উদ্যোক্তাদের কয়েকজন বলছেন, বায়াররা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। শিল্প মালিকদের মন্তব্য— জ্বালানি সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ ও ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতি, বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বেশ কয়েকটি কারণে তৈরি পোশাক রফতানিতে ঝুঁকি বাড়ছে।

গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা জানান, বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বড় পোশাক রফতানির গন্তব্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র। পোশাক রফতানি আয়ের ২০ থেকে ২২ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু বর্তমানে এই মার্কেটে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে পোশাক খাতে ১০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার শ্রমিক। শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না অন্তত ১৫৮টি কারখানা।

এদিকে ইউরোপীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর— এই ১০ মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম কমিয়েছে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমানোর পর আমাদের উৎপাদন খরচ আরও বেড়েছে। এটি দেশের পোশাকশিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক কারখানা মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। পোশাকের দাম না বাড়ানো হলে অনেক কারখানাই ৯ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বাস্তবায়ন করতে পারবে না।

এখনও পোশাকের দাম নিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কম মূল্যের কারণে অনেক ক্রয়াদেশই নেওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো না গেলে ক্রয়াদেশ থাকলেও রফতানি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে বেশিদিন টিকে থাকা যাবে না।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা কমে গেছে। বেশিরভাগ কারখানার মালিক লোকসান দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন। বড় লোকসান থেকে বাঁচতে বেশিরভাগ কারখানার মালিক কম দামে পোশাক বিক্রি করছেন। আগে যে পোশাক বিক্রি করে আমরা ১০০ টাকা পেতাম, এখন সেই একই পোশাক বিক্রি করে পাচ্ছি ৯৫ টাকা। অথচ আগে যে পোশাক তৈরি করতে আমাদের খরচ ১০০ টাকা, এখন সেই একই পোশাক তৈরি করতে খরচ করতে হচ্ছে ১৫০ টাকা।

‘প্রায় ৫০ শতাংশের মতো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এই খাতের বেশিরভাগ উদ্যোক্তার মুনাফা হচ্ছে না। হয়তো হাতে গোনা কেউ কেউ ১ থেকে ২ শতাংশ প্রোফিট করছেন’, উল্লেখ করেন এই উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে পোশাকের দাম বাড়ানো জরুরি ছিল, অথচ ক্রেতারা উল্টো দাম কমিয়েছে। এতে অনেক কারখানা, বিশেষ করে ছোট এবং মাঝারি সাইজের প্রতিষ্ঠানগুলো এখন লোকসানে চলছে।

ইউরোস্ট্যাটের প্রতিবেদনের তথ্যই বলছে— ইউরোপে বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমেছে প্রায় ৫ শতাংশের মতো।

ইউরোস্ট্যাটের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর এই ১০ মাসে তৈরি পোশাক আমদানি করেছে ১ হাজার ৬৫২ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ে তারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি করছিল ১ হাজার ৬২৮ কোটি ডলারের। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পোশাক রফতান বেড়েছে মাত্র ২৪ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

এদিকে ওটেক্সার তথ্যে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি এসব পোশাকের দাম বর্তমানে ৩ দশমিক ৮ থেকে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। বিশেষ করে ছেলেদের কটন ওভেন ট্রাউজার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, কটন ওভেন শার্ট ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কটন নিট টি-শার্টের দাম কমেছে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এক বছর আগে এসব পণ্যের দাম যা ছিল, এখন সেই একই পণ্য তার থেকে প্রায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ কম দামে আমদানি করছে দেশটি। এই দাম কমানোর ফলে বাংলাদেশি পোশাকের রফতানি আয়ও কমেছে। গত বছর যেখানে ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল, সেখানে চলতি বছর একই সময়ের মধ্যে রফতানি হয়েছে ৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার, যা ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দেশের পোশাক রফতানি কমেছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ

পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে ইউরোপের বাজারে পোশাক রফতানি কম হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে প্রায় ৬১ কোটি ৩২ লাখ ইউরো, ফেব্রুয়ারিতে ২৯ কোটি ১০ লাখ ইউরো এবং মার্চে রফতানি কমেছে ১৫ কোটি ৭০ লাখ ইউরো। তবে এপ্রিল ও মে মাসে রফতানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ৪০ কোটি ১৭ লাখ ও ২৭ কোটি ৩৭ লাখ ইউরোতে দাঁড়িয়েছে। পোশাক রফতানিতে ছন্দপতন ঘটে চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ে। এর মধ্যে জুনে প্রায় ৭ কোটি ইউরো এবং জুলাইয়ে প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ ইউরো রফতানি কম হয়েছে। তবে আগস্টে প্রায় ৬ কোটি ৫৫ লাখ ইউরো, সেপ্টেম্বরে প্রায় ১০ কোটি ৫৫ লাখ ইউরো এবং অক্টোবরে রফতানি বৃদ্ধি বেড়েছে প্রায় ৪৪ কোটি ২৩ লাখ ইউরোতে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়