বৃহস্পতিবার   ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ , ২৬ পৌষ ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রকাশিত: ১২:০৩, ৮ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১২:০৩, ৮ জানুয়ারি ২০২৫

আগে সংসদ নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন নয়: বিএনপি

আগে সংসদ নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন নয়: বিএনপি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপি। দলটির অভিমত, এ ধরনের সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার নজির নেই। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে জনআকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে এখন সরকারের উচিত জাতীয় নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা। একই সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপি বলেছে, ঘোষণাপত্রে গণতন্ত্রের জন্য বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর বিগত ১৬ বছরের লড়াই-সংগ্রাম ও ত্যাগের কথা উল্লেখ নেই। তাই সরকারি উদ্যোগের ডিক্লারেশনে এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্তিতে এখন থেকে সোচ্চার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। 

এছাড়া ভোটারের ন্যূনতম বয়সসীমা ১৮ বছরের বিষয়টি মীমাংসিত উল্লেখ করে নেতাদের মত, এটা নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। তবে এমনটা করলে তাতে জটিলতা বাড়বে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কালক্ষেপণ হবে। সুতরাং ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছরই থাকা উচিত। 

সোমবার রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির নেতারা এমন অভিমত দেন। রাত পৌনে ৯টা থেকে পৌনে ১১টা পর্যন্ত ২ ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠক হয়। লন্ডন থেকে বৈঠকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। 

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল কাজ হচ্ছে নির্বাচনকালীন সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া। যদি তা না করে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ভাবে তাহলে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে এই সরকার জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে যাচ্ছে। অবশ্য আমরা মনে করি, এই সরকার তা করবে না। 

৬ জানুয়ারি রাজধানীতে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। সেখানে কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় পর্যায়ে সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হলেও ঢাকার বাইরে মানুষের মতামতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যেও এ মতামত আছে। ঢাকার বাইরে মতবিনিময় করতে গিয়ে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এ চিত্র পাচ্ছে। এর আগে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একাধিক মতবিনিময়েও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার বিষয়ে পরামর্শ উঠে এসেছিল। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনো কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। 

এদিকে বিষয়টি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়। দলটির নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান না বলে অভিমত দেন। তারা বলেন, এই ধরনের সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার নজির নেই। সরকারের উচিত জনআকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা। সরকারকে কোনো চাপ কিংবা কোনো পক্ষ বা কারওর স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে জনস্বার্থে দেশকে নির্বাচনমুখী করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

সূত্রমতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে। বিএনপির নেতারা মনে করেন, এই ঘোষণাপত্রে তাদের বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের স্বীকৃতি থাকতে হবে। কেননা, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করতে গিয়ে এই সময়ে তাদের অসংখ্য নেতাকর্মী গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। নেতাদের দাবি, হঠাৎ করে নয়-বিএনপির গত ১৬ বছরের আন্দোলনের পটভূমিতে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। সুতরাং এই গণ-অভ্যুত্থান শুধু ৩৬ দিনের আন্দোলনের ফল নয়। কিন্তু বিএনপির সেই দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। এমন প্রেক্ষাপটে ঘোষণাপত্রে গণতন্ত্রের জন্য বিএনপির ১৬ বছরের সংগ্রাম-ত্যাগের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তিতে সোচ্চার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ লক্ষ্যে শিগগিরই সভা-সেমিনারের মধ্য দিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন, তাদের ত্যাগের বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে। এছাড়া আগামীতে সরকারের সঙ্গে আলোচনায়ও এ বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরবে বিএনপি।

৩১ ডিসেম্বর ছাত্রদের ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেয়ার উদ্যোগ এবং শেষ মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক ঐকমত্যে এই ঘোষণাপত্র তৈরির ঘোষণায় তা স্থগিত করা হয়। ডিক্লারেশন প্রশ্নে ছাত্র এবং সরকারের এই অবস্থান বিএনপির কাছে স্পষ্ট নয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এই ইস্যুতে সরকার যখন আলোচনার উদ্যোগ নেবে, তখন বিষয়টি তুলে ধরবে বিএনপি। 

দেশে ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারণ করা উচিত বলে ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অভিমত দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয় এবং বিএনপি নেতারা অভিমত দেন। তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছর। এটা নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। তবে এখন ভোটারের বয়স কমালে জটিলতা বাড়বে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কালক্ষেপণ হবে। এছাড়া স্থায়ী কমিটি মনে করে, ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছরই থাকা উচিত।

জানা যায়, ছাত্রদের জুলাই ঘোষণাপত্রের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাহাত্তরের সংবিধানকে বাতিল করা। এ ক্ষেত্রে বিএনপির আপত্তি রয়েছে, যেটি দলটির নেতারা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন। স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে ফের আলোচনা হয়েছে। নেতারা মনে করেন, সংবিধানের বাইরে গেলে দেশে অস্থিরতা তৈরি হবে। তাছাড়া ছাত্ররা যে সংবিধান বাতিল করে দেওয়ার কথা বলছে, সেই বাহাত্তরের সংবিধানের আলোকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনসহ রাষ্ট্রের সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। অর্থাৎ এই সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রের কাঠামোগত একটা অবস্থান আছে। সুতরাং যারা এটা বাতিলের কথা বলছে, তাদের পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বিএনপির অভিমত, সংবিধান কখনো কবর দেওয়া যায় না। পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা সংশোধন হতে পারে। সেটাই হবে সর্বোত্তম পন্থা। 

এদিকে সরকার বিজয় দিবসে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমার ব্যাপারে একটা ধারণা দিলেও এখনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেয়নি। এর পেছনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাপ থাকতে পারে বলেও বৈঠকে কেউ কেউ অভিমত দেন। তারা বলেন, ছাত্ররা সরকারি সহযোগিতায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে। সেই দলকে সংগঠিত করা এবং সারা দেশে এর কার্যক্রম বিস্তৃত করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। সেজন্য তারা দ্রুত নির্বাচন চায় না। তবে বিএনপি মনে করে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে এবং জনগণের পালস বুঝে সরকারকে রোডম্যাপ দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে সামনের দিকে এগোনো দরকার। কারণ, দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। তাছাড়া নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, সংকটও তত বাড়বে।

বৈঠকে খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিয়েও আলোচনা হয়। বিএনপি নেতারা বলেন, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার সব সুযোগ বন্ধ করে রেখেছিল। গুরুতর অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাকে বিদেশে যেতে দেওয়া হয়নি। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি এখন যে বিদেশে যাচ্ছেন, এটা তাদের জন্য অনেক স্বস্তির বিষয়। বৈঠকে বিএনপির চেয়ারপারসনের সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়, চিকিৎসা শেষে তিনি দ্রুত দেশে ফিরে আসবেন।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়