টিসিবির ট্রাক সেল বন্ধ, ৪৩ লাখ পরিবারের কার্ড বাতিল
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য গত অক্টোবর মাসে ট্রাকে করে তেল, ডাল ও চাল বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। ফলে টিসিবির পরিবার কার্ড না থাকলেও প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাড়ে ২৪ হাজার মানুষ ভর্তুকি মূল্যে এসব পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন। মাত্র দুই মাস সাত দিন চলার পরে এ কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছে সংস্থাটি।
অন্যদিকে গত অক্টোবরে ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এটিও সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অনিয়মের অভিযোগে সারা দেশে টিসিবির এক কোটি পরিবার কার্ডের মধ্যে ৪৩ লাখ কার্ড বাতিল করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ কষ্টে রয়েছেন। এ অবস্থায় ট্রাক সেলের মতো কর্মসূচি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। উল্টো এসব কর্মসূচি বন্ধ বা আওতা কমানোর ফলে গরিব মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে।
ট্রাক সেল বন্ধ
গত বছরের পুরো সময়জুড়ে দেশের মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত বছর টানা ৯ মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে। বিশেষ করে বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে চাল, পেঁয়াজ, আলু, মুরগি, ডিমসহ নিত্যপণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়।
এমন পরিস্থিতিতে গত ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা মহানগরের ৫০টি ও চট্টগ্রাম মহানগরের ২০টি স্থানে ট্রাকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম শুরু করে টিসিবি। প্রতিটি ট্রাকে ৩৫০ জনের পণ্য থাকত। ট্রাক থেকে একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ দুই লিটার ভোজ্যতেল, পাঁচ কেজি চাল ও দুই কেজি মসুর ডাল কিনতে পারতেন। এতে একজন গ্রাহকের অন্তত ৩৫০ টাকা বা তার বেশি অর্থ সাশ্রয় হয়। গত ৩১ ডিসেম্বরের পর থেকে এ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
টিসিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত অক্টোবরে তাঁরা সাময়িকভাবে এ কর্মসূচি (ট্রাক সেল) শুরু করেছিলেন। পরে এক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলে। এরপর ট্রাক সেল চালু রাখার বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা না আসায় বিক্রি বন্ধ রয়েছে। নতুন নির্দেশনা এলে পুনরায় চালু হবে।
জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। ট্রাক সেল বিক্রির কার্যক্রমটি পুনর্বিবেচনা করা হবে।’
এদিকে গত সেপ্টেম্বর–অক্টোবর মাসে দেশে মুরগি–ডিমসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে গত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ট্রাকে করে কয়েকটি কৃষিপণ্য বিক্রি শুরু করে সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এর আওতায় সুলভ দামে আলু, ডিম, পেঁয়াজ, পটোলসহ কয়েকটি কৃষিপণ্য বিক্রি করে সংস্থাটি। এই কর্মসূচিও ২৭ ডিসেম্বরের পর থেকে বন্ধ রয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম জানান, বর্তমানে সবজির দাম কমে যাওয়ায় এখন কৃষিপণ্যের ট্রাক সেল কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে। তবে সরকার চাইলে দাম বেশি রয়েছে, এমন কোনো কৃষিপণ্য নিয়ে তাঁরা কাজ করতে পারেন।
পরিবার কার্ডের সংখ্যা কমেছে
আগে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকে করে ডিলারদের মাধ্যমে সুলভ মূল্যে সবার জন্য পণ্য বিক্রি করত টিসিবি। তবে ২০২২ সালের জুনে ট্রাক সেলের পরিবর্তে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ‘পরিবার কার্ড’ কর্মসূচি নেওয়া হয়। এর আওতায় দেশে এক কোটি পরিবারের কাছে প্রতি মাসে কয়েকটি পণ্য বিক্রি করে আসছিল টিসিবি। পরিবার কার্ডের মাধ্যমে একজন ক্রেতা মাসে সর্বোচ্চ দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি মসুর ডাল, এক কেজি চিনি ও পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারেন।
তবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এসব পরিবার কার্ড বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ অনিয়ম খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। নানা যাচাই–বাছাই শেষে এক কোটির মধ্য থেকে ৪৩ লাখ কার্ড বাদ দেওয়া হয়।
টিসিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিগত সময়ে অনিয়মের মাধ্যমে যাঁদের কার্ড দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা তালিকা থেকে বাদ গেছেন। এ ছাড়া অবশিষ্ট ৫৭ লাখ পরিবারের মধ্যে আগের কাগুজে কার্ডের পরিবর্তে গত বুধবার থেকে স্মার্ট কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা এক কোটি করা হবে।
টিসিবির বাইরে খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমেও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল ও আটা বিক্রি করা হয়। ঢাকা মহানগরে মোট ১৯১টি বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে চাল–আটা বিক্রি করে খাদ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে ৭০টি স্থানে ট্রাকে করে বিক্রি করা হয়। এসব বিক্রয়কেন্দ্র (ট্রাক বা দোকান) থেকে একজন ভোক্তা ৩০ টাকা দরে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি চাল ও ২৪ টাকা দরে পাঁচ কেজি খোলা আটা কিনতে পারেন।
খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা মহানগর ছাড়াও শ্রমঘন চার জেলা (ঢাকা, গাজীপুর নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ), সব সিটি করপোরেশন এবং জেলা পৌরসভাগুলোতে বর্তমানে তাদের ওএমএস কর্মসূচি চলছে। এর বাইরে উপজেলা পর্যায়েও ওএমএস কর্মসূচি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। চলতি মাসেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
গত অক্টোবরে টিসিবির ট্রাক সেল কর্মসূচি চালুর সময়ে টিসিবি জানিয়েছিল, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে না এলে পরবর্তী সময় কার্যক্রমটি বাড়ানো হতে পারে। বিবিএসের হিসাবে সর্বশেষ ডিসেম্বরেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। সবজি ছাড়া অন্যান্য পণ্যের দাম সেভাবে না কমলেও টিসিবির ট্রাক সেল কর্মসূচির মেয়াদ আর বাড়েনি। এমন পরিস্থতিতে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক বলেন, ট্রাক সেল কর্মসূচি বন্ধ করা উচিত হয়নি। বাতিল হওয়া টিসিবির ৪৩ লাখ পরিবার কার্ডের সমপরিমাণ পণ্য আপাতত ওএমএস বা ট্রাক সেলের মাধ্যমে বাজারে বিক্রি করা যেত, তাতে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেতেন।