বুধবার   ২২ জানুয়ারি ২০২৫ , ৯ মাঘ ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রকাশিত: ১১:৫৫, ১১ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৮:৩৪, ১১ জানুয়ারি ২০২৫

কর-শুল্ক বাড়ায় রান্না, মুঠোফোন, ইন্টারনেট, ওষুধসহ শতাধিক পণ্যে গুনতে হবে বাড়তি টাকা

কর-শুল্ক বাড়ায় রান্না, মুঠোফোন, ইন্টারনেট, ওষুধসহ শতাধিক পণ্যে গুনতে হবে বাড়তি টাকা

নতুন করে প্রয়োজনীয় শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। বাড়তি করের চাপটি এমন সময় এল, যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছেন মানুষ। গত ডিসেম্বরেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে শত পণ্যের শুল্ক ও কর বৃদ্ধি সাধারণভাবেই মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়াবে।

শুল্ক-কর বাড়ানো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে গতকাল এক পোস্টে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, ‘এই সিদ্ধান্তগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে সরকারের মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো সঠিক সমন্বয় নেই। সরকারের উচিত ছিল, এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে দরিদ্র ও সাধারণ জনগণের সহায়তার পরিসর বাড়ানো এবং বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।’

সেলিম রায়হান বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই সহজ পথে হাঁটছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের বাজেট পর্যালোচনা করা দরকার ছিল। সেটি না করায় আসলে আগের সরকারের কাঠামোই মূলত অনুসরণ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি আরও বলেন, ‘অতীতে অনেক ক্ষমতাশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর অব্যাহতির অন্যায় সুযোগ নিয়েছে। অনেক সম্পদশালী কর ফাঁকি দিয়েছেন। সেগুলো বন্ধ করে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর সুযোগ আছে। আমাদের প্রত্যাশা, এই সরকার সেই কঠিন কাজটি করবে।’

চলতি অর্থবছরের মাঝে হঠাৎ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে গত বৃহস্পতিবার অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার; যা ওই রাতেই কার্যকর হয়ে গেছে। অংশীজনদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই ১ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধিসংক্রান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রস্তাব পাস হয়। তারপর ভোক্তা পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সংগঠন ও অর্থনীতিবিদেরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেন। একপর্যায়ে ৪ জানুয়ারি এনবিআর এক বিবৃতিতে দাবি করে, যেসব পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নেই। এতে সর্বসাধারণের ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে না; মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে না।

অবশ্য অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ওষুধ, এলপিজি, রেস্তোরাঁর খাবার, মুঠোফোন সেবা, বিস্কুট-কেক, টিস্যু পেপার, তৈরি পোশাক, বিদেশি ফল ও জুসের ওপর বাড়তি কর আরোপ করা হয়েছে, যা কি না সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের ব্যবহার্য পণ্য ও সেবা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ব্যয় বাড়বে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, টাকা ছাপিয়ে সরকার চালানোর চেয়ে কর বাড়ানো ভালো। তবে নিত্যপণ্যের ওপর কর বাড়ানো হলে স্বল্প আয়ের মানুষ চাপে পড়ে। নিত্যপণ্যে কর বাড়ানোর চেয়ে কর সংগ্রহে জোর দেওয়া প্রয়োজন; যাতে মানুষের কাছ থেকে নেওয়া কর অন্য কারও পকেটে না যায়। ভ্যাট আদায়ের বিষয়টি পুরোপুরি অনলাইনে করা দরকার। ওষুধের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট বাড়ানো ঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

যেসব পণ্য ও সেবায় কর ও শুল্ক বাড়াবে, তার মধ্যে রয়েছে মুঠোফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে। আবার ব্র্যান্ড কিংবা ব্র্যান্ড নয় এমন পোশাকে ভ্যাটের হার দ্বিগুণ করা হয়েছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) রেস্তোরাঁয় খাওয়ার খরচও বাড়বে; কারণ, সেখানে ভ্যাট তিন গুণ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে ওষুধ, মিষ্টি, এলপি গ্যাস, আমদানি করা ফল ও ফলের রস, ড্রিংক, বিস্কুট, চশমার ফ্রেম, বিভিন্ন ধরনের টিস্যু, সিগারেটসহ নানা পণ্যের। এসব পণ্যভেদে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। আবগারি শুল্ক বাড়ানোয় আকাশপথে ভ্রমণে খরচও বাড়বে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন শর্তে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। গত মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ঋণ কর্মসূচির আকার আরও ৭৫ কোটি ডলার বাড়ানোর অনুরোধ করে। এই অর্থ দিতেও সম্মত হয়েছে সংস্থাটি। তবে কর আদায় ও নীতি গ্রহণকারী সংস্থাকে আলাদা করাসহ রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর মতো কিছু কঠোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। মূলত তাদের শর্ত মানতেই অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে শুল্ক ও কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, এমনটাই বলছেন রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইএমএফ সব সময় ভ্যাটের হার একক করার কথা বলছে। তবে সেটি ১৫ শতাংশ হতে হবে, তা বলে দেয়নি সংস্থাটি; বরং সরকারের ইচ্ছায় তা কম-বেশি হতে পারে। তবে সব পণ্যের ক্ষেত্রে একই হারের পক্ষে আইএমএফ। তা ছাড়া বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় বছরে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছিল সংস্থাটি। সেটা কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নির্ভর করে সরকারের ওপর। সরকার চাইলে আয়কর বাড়িয়ে, করের আওতা বাড়িয়ে এবং কর ফাঁকি বন্ধ করে বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ল, যা সময়োপযোগী হয়নি। করের হার বৃদ্ধি করা তখনই উচিত, যখন আর কোনো উপায় থাকে না। দুর্নীতি কমানো, করজাল বৃদ্ধি, সরকারের ব্যয় কমানো ইত্যাদির মাধ্যমে চেষ্টা করে দেখা যেত। তিনি আরও বলেন, আইএমএফের শর্তের কারণে বছরের মাঝপথে সরকার শুল্ক–কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। যদি আইএমএফ এমন শর্ত দিয়েও থাকে, তাহলে তাদের কাছ থেকে ছয় মাস সময় চাওয়া যেত। আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতে আগামী বাজেটে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া যেত বলে মনে করেন তিনি।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়