বুধবার   ২২ জানুয়ারি ২০২৫ , ৯ মাঘ ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

চালের দাম বেড়েই চলছে, সরকারের নজর নেই

চালের দাম বেড়েই চলছে, সরকারের নজর নেই

মধ্যবিত্তরা সরু চাল খেতে অভ্যস্ত। মিনিকেট ও নাজিরশাইল সরু চালের মধ্যে দুটি জনপ্রিয় নাম। রাজধানীর বাজার থেকে এই দুই চাল কিনতে প্রতি কেজিতে দাম দিতে হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। বেশি কিনলে দু-এক টাকা কম পাওয়া যায়।

সরু চালের দাম গত এক মাসে কেজিতে ৫ থেকে ৮ টাকা বেড়েছে। এভাবে ধাপে ধাপে সরু চালের দাম বাড়ছে ২০২০ সাল থেকেই। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি এক কেজি সরু চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল ৪৫ টাকা, যা এখন ৭০ টাকা। সর্বোচ্চ দর ছিল ৬০ টাকা, যা এখন ৮৪ টাকা।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রশিদ, ডায়মন্ড, সাগর, মোজাম্মেল ইত্যাদি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের সরু মিনিকেট চাল আসলে ৮০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। সুপারশপে সুদৃশ্য মোড়কে বিক্রি হওয়া মিনিকেটের দাম আরও বেশি, ৯০ টাকার আশপাশে। ফলে মধ্যম আয়ের মানুষকে ৮০ টাকা কেজি চাল কিনতে হচ্ছে।

মোটা চালের দামও কম নয়। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি যা ৩০-৩৫ টাকা ছিল, তা এখন ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা কেজি। এ হিসাব টিসিবির। ঢাকার শেওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও টাউন হল বাজার ঘুরে অবশ্য ৫৫ টাকার নিচে কোনো সেদ্ধ চাল পাওয়া যায়নি। মোটামুটি ভালো মানের মোটা চাল কিনতে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা দিতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষকে। এক মাসে মোটা চালের দাম বেড়েছে তিন থেকে চার টাকা। অন্যদিকে বাজারে মাঝারি চাল পাওয়া যাচ্ছে জাতভেদে ৬০ থেকে ৬৬ টাকায়।

মোটা চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারি নানা চেষ্টা আছে। খোলাবাজারে খাদ্য অধিদপ্তর ভর্তুকি মূল্যে মোটা চাল বিক্রি করে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় দরিদ্রদের চাল সহায়তা দেওয়া হয়। রয়েছে রেশনব্যবস্থা। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের চালের দাম কমাতে তেমন চেষ্টা নেই। তারা টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডও পায় না। নিত্যপণ্য কিনতে তাদের পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় বাজারের ওপর।

রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. শামসুল ইসলাম বলছিলেন, তিনি প্রতি মাসে গড়ে ৩৫ কেজি মিনিকেট (রশিদ) চাল কেনেন। এতে তাঁর খরচ হয় প্রায় আড়াই হাজার টাকা। কিন্তু চলতি মাসে চাল কিনতে প্রায় ২৮০ টাকা বেশি লেগেছে। কারণ, বাজারে চালের দাম বেড়েছে।

শামসুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বেশি দামের কারণে এমনিতেই অন্যান্য বাজার করতে গিয়ে হিমশিম অবস্থায় আছি। এখন চালের দামও বাড়ল।’

আরও কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে গড়পড়তা যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে দেখা দেখা যায়, চার সদস্যের একটি পরিবারে মাসে ২৫ কেজির মতো চাল লাগে। চালের দাম ৫ টাকা বাড়লে খরচ বাড়ে ১২৫ টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী বলছিলেন, চালের পেছনে ১২৫ টাকা বাড়তি খরচ খুব বেশি মনে না-ও হতে পারে। কিন্তু এভাবে একটি-দুটি করে পণ্যের দাম বাড়তে বাড়তে বড় চাপ তৈরি হয়। তিনি বলেন, সব দেশেই প্রধান খাদ্যগুলোর দাম কম থাকে। বাংলাদেশে কোনটি কম? মাছ, মাংস, দুধ, ডিম—সবকিছুই তো চড়া। মানুষ তো হিমশিম খাচ্ছে।

মধ্যবিত্তের চালের বাজারটির নিয়ন্ত্রণ করে মূলত বড় বড় কিছু মিল, যারা নিজেদের ব্র্যান্ড নামে চাল বাজারে ছাড়ে। মিলগুলো সব সময় ধানের চড়া দাম ও অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়াকে চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী করে আসছে। নতুন করে চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার খাজানগরের গোল্ডেন অটো রাইস মিলের মালিক জিহাদুজ্জামান বলেন, ‘প্রথমত, গত বছর সরকার ব্যাপক চাপে রেখেছিল, যাতে দাম না বাড়ে। সেই প্রভাব এখন পড়ছে। দ্বিতীয়ত, এ বছর প্রায় সব ধান বড় কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়েছে। সাধারণ মিলমালিকেরা ধানই পাচ্ছেন না। দামও বেশি। তিনি বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার ধানের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেশি। এ জন্যই চালের দাম এত বেড়ে গেছে।

কিন্তু বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধানের দামের চেয়ে চালের দাম অনেক বেশি বাড়ে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে প্রতি কেজি মাঝারি বোরো ধানের পাইকারি দর ছিল ২৭ টাকার মতো। সেটা ২০২৩ সালে বেড়ে হয় ৩০ টাকার কিছু বেশি। এ সময়ে ধানের দাম বেড়েছে ১২ শতাংশের কিছু বেশি। বিপরীতে একই সময়ে খুচরায় সরু চালের দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ।

বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশের চালের বাজারে বড় বড় প্রতিষ্ঠান ঢুকেছে। তাদের কাছে অর্থের কোনো অভাব নেই। বিপুল পরিমাণ ধান মজুত করে বাজার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা তাদের রয়েছে। তারা চাইলেই ব্যাংকের ঋণ পায়। বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে তাদের প্রতিযোগিতায় ফেলা গেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতো। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর কোনো বাজারকৌশল না নিয়ে লোকদেখানো অভিযানে বেশি আগ্রহী ছিল।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের অনুরোধে করা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়, চালের বাজারে বড় মিলের সংখ্যা ৫০। তারা চালের বাজারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। তারা ধান কেনা, মজুত থেকে শুরু করে তা ভাঙিয়ে চালে পরিণত করাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে।

যথাসময়ে পদক্ষেপ না নেওয়ায় এখন বিদেশ থেকে চাল আমদানি কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এখন চালের দাম প্রতি টন ৫০০ ডলারের আশপাশে, যা গত বছরের চেয়ে টনে ১০০ ডলারের মতো কম। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এই দরেও চাল আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কারণ, ডলারের দাম এখন ১২৩ টাকা। এই দরে চাল আমদানি করলে কেজিতে ক্রয়মূল্য পড়বে ৬২ টাকার মতো। তারপর জাহাজভাড়া, অন্যান্য খরচ এবং আমদানি, পাইকার ও খুচরা পর্যায়ে মুনাফা যোগ হবে। কিছু শুল্ক-করও রয়েছে।

বাংলাদেশে চাল আমদানি সাধারণত নিষিদ্ধ থাকে। প্রয়োজন হলে আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। তা-ও অবাধ নয়, আগে অনুমতি নিতে হয়। শুল্ক-করের হারও উচ্চ। চাল আমদানিতে শুল্ক-কর ছিল সাড়ে ৬২ শতাংশ, যা অক্টোবরে কমিয়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনে সরকার; কিন্তু চাল তেমন একটা আসছে না।

বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা সরকারের একটি সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বড় মিলমালিকেরা যখন দেখেন বিদেশ থেকে আমদানির সুযোগ নেই, তখন ইচ্ছেমতো দাম বাড়ান। তিনি বলেন, চাল আমদানি নিষিদ্ধ রেখে, উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করে বড় ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁদের খরচ কত, কত দামে বিক্রি করেন, মজুত কত—এসব বিশ্লেষণ দরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সেদিকে কোনো আগ্রহ আছে?
 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়