বিশ্ববিদ্যালয় হলের ‘গেস্টরুম’ সংস্কৃতির অবসান

বিগত সরকারের সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলোতে ‘গেস্টরুম’ নামে ছাত্রলীগের নির্যাতনের যে সংস্কৃতি ছিল, সেটি বন্ধ হয়েছে। হলে থাকার জন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা এখন নেই। আবাসিক হলগুলোতে দখলদারত্বেরও অবসান হয়েছে সব কটি ক্যাম্পাসেই।
তবে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদলসহ বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো সক্রিয় আছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য কার্যক্রম শুরু করেছে এত দিন গোপনে রাজনীতি করে আসা ইসলামী ছাত্রশিবির। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে এখন জোরালো হচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনসংকট অনেকটাই কমেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র
আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসন অকার্যকর ছিল। ছাত্রদের ১৩টি হল পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করত ছাত্রলীগ। কে কোন কক্ষে থাকবে, তা ঠিক করতেন ছাত্রলীগের নেতারা। শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যেতে হতো। বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অবস্থা ছিল সবচেয়ে করুণ। গাদাগাদি করে হলের গণরুমে থেকে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি ‘গেস্টরুমে’ নির্যাতনের শিকারও হতে হতো তাঁদের। ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ কথায় তাঁরা উঠতে-বসতে বাধ্য থাকতেন। এ ছাড়া হলগুলোর ক্যানটিনে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজির কারণে শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের খাবার খেতে হতো।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেই গত বছরের ১৬ জুলাই রাতে ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়েছে। নতুন প্রশাসন আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রও অনেকটা বদলে গেছে। এখন হলগুলোতে রাজনৈতিক গণরুম নেই, ‘গেস্টরুমে’ নির্যাতনও নেই। প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে হলে আসন বণ্টন করা হচ্ছে। কিন্তু অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর চাপের কারণে কিছু হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। অবশ্য ক্যানটিনের খাবারের মানে তেমন পরিবর্তন আসেনি। এর প্রধান কারণ বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি হলের শিক্ষার্থীরা বলছেন, আগে হলে তাঁরা একধরনের আতঙ্কে থাকতেন। সেই ভয়ের পরিবেশ এখন নেই। মাস্টারদা সূর্য সেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আলী হাসান ওয়াহিদ বলেন, এখন হলে গণরুম-গেস্টরুম নেই। তবে ক্যানটিনের খাবারের মানে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসেনি।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও জোরজবরদস্তির রাজনীতির বিপরীতে এখন হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বলে জানান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল রিফাত।
৫ আগস্টের পর ছাত্রীদের হলেও এসেছে পরিবর্তন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের ছাত্রী আনিকা তামজীদ বলেন, আগে হলে বেশ কিছু রাজনৈতিক কক্ষ ছিল, যেগুলোতে হল প্রশাসন আসন বণ্টন করতে পারত না। তবে এখন সব রাজনৈতিক কক্ষ খালি হওয়ায় হল প্রশাসন সেগুলোতে প্রশাসনিকভাবে আসন বণ্টন করতে পারছে। এমনকি প্রথম বর্ষের ছাত্রীরাও প্রয়োজনের ভিত্তিতে হলে আসন পাচ্ছেন। অবশ্য খাবারের মানে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি বলে জানালেন তিনি।
হলের বাইরে ক্যাম্পাসে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণেও পরিবর্তন এসেছে বলে জানালেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাঁরা আরও জানান, হলগুলোর অভ্যন্তরে রাজনৈতিক কার্যক্রম এখন বন্ধ আছে। কিন্তু হলের বাইরে ক্যাম্পাসের টিএসসিসহ বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক কর্মসূচি অব্যাহত আছে। ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি উঠেছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুটি কমিটি গঠন করেছে। ছাত্রসংগঠনসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে এখন কমিটিগুলো আলোচনা করছে।
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও গত ১৬ জুলাই রাতে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করেন শিক্ষার্থীরা। সরকার পতনের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীসহ সবাই নিজের আসন বুঝে পেয়েছেন। আগে ক্যাম্পাসে গেস্টরুমে নির্যাতন ও র্যাগিংয়ের যে সংস্কৃতি ছিল, সেই সংস্কৃতি এখন আর নেই। ফলে ক্যাম্পাসে আতঙ্কের পরিবেশ নেই।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হামলার সরাসরি মদদ ও নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর, সাবেক ডিনসহ কয়েকজন শিক্ষক ক্যাম্পাসে ফিরতে পারেননি।
জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন ও চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ। ১ ফেব্রুয়ারি জাকসুর তফসিল ঘোষণার কথা থাকলেও ছাত্রদলসহ কয়েকটি সংগঠনের আপত্তির মুখে প্রশাসন সেটি ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপপক্ষের দলাদলি ও মারামারিতে কিছুদিন পরপরই উত্তপ্ত হতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। হলগুলো ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষের দখলে ছিল। ৫ আগস্টের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও কোনো ছাত্রসংগঠনের দখলদারত্ব নেই, কোনো সংঘর্ষও হয়নি। গত ৪ অক্টোবর দীর্ঘ সাত বছর পর হলগুলোতে আসন বরাদ্দ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা ফলাফলের ভিত্তিতে আসন বরাদ্দ পেয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে এখন পর্যন্ত ২০টির বেশি কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনও নির্বাচন চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগ সিট–বাণিজ্য করত। কিন্তু ৫ আগস্টের পর সব কটি হলে এখন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আবেদন নিয়ে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে হল কর্তৃপক্ষ আসন বরাদ্দ দিচ্ছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনা নেই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এখনো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে বলে জানান রাকসু আন্দোলন মঞ্চের সদস্যসচিব আমান উল্লাহ খান। তিনি বলেন, অনেকেই সেশনজটে ধারাবাহিকভাবে পড়ে আছে। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন। বর্তমান উপাচার্য বলেছেন, চলতি মাস ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে।
আওয়ামী লীগের পতনের পর রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) হলগুলোতেও দখলদারত্বের অবসান হয়েছে। অবশ্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো কেউ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তোলেনি।
আগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছাত্রলীগের দখলে ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর যাঁরা আসন বরাদ্দ পেয়েছেন, তাঁরাই হলে থাকছেন। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফুলপরী খাতুনের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু গত ছয় মাসে ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি উঠেছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে কারও একক আধিপত্য নেই। ৫ আগস্টের পর ক্যাম্পাসে খেলাধুলা বেড়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন প্রশাসনিকভাবে আসন বণ্টন হচ্ছে। গণরুম বিলুপ্ত হয়েছে, ‘গেস্টরুম’ নির্যাতনও বন্ধ হয়েছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের নামফলক পরিবর্তন ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনসংকট প্রকট হচ্ছে, শিক্ষকসংকটও আছে। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। আন্দোলনে সরাসরি হামলায় জড়িতরা ছাড়া ছাত্রলীগের অন্য নেতা-কর্মীরা ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) আবাসিক হলে মেধার ভিত্তিতে আসন বণ্টনের চেষ্টা চলছে। এখানে গত ছয় মাসে গেস্টরুম নির্যাতনের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। কুয়েটে ছাত্রলীগের পদধারী নেতারা ক্লাস-পরীক্ষা দিতে আসছেন না।