বুধবার   ২৩ অক্টোবর ২০২৪ , ৭ কার্তিক ১৪৩১

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :

প্রকাশিত: ১১:১৬, ২২ অক্টোবর ২০২৪

আত্মহত্যা করছেন গাজাফেরত অনেক ইসরায়েলি সেনা

আত্মহত্যা করছেন গাজাফেরত অনেক ইসরায়েলি সেনা

গাজা থেকে ফেরার পর ইসরায়েলের হাজার হাজার সেনা পিটিএসডিসহ (পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার) নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তাদের অনেকে আত্মহত্যা করেছেন। তবে কতজন আত্মহত্যা করেছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি।

গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১১ মে পর্যন্ত ১০ জন ইসরায়েলি সেনা আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের একটি পত্রিকা।

উল্লেখ্য, ইসরায়েলে বছরে পাঁচ শতাধিক মানুষ আত্মহত্যা করেন। এ ছাড়া ছয় হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য। আর সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ইসরায়েলি সেনাদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ ছিল আত্মহত্যা।

গত আগস্টে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতি মাসে এক হাজারের বেশি আহত সেনাসদস্যকে চিকিৎসার জন্য ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তাঁদের ৩৫ শতাংশ নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অভিযোগ করেছেন।

গাজা যুদ্ধের সময় যত গড়িয়েছে, ততই আকাশচুম্বী হয়েছে লাশের সংখ্যা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলায় নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন। এরপর থেকে ইসরায়েলের নৃশংস হামলায় তছনছ হয়েছে পুরো গাজা। সেখানে এখন পর্যন্ত নারী ও শিশুসহ ৪২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এরই মধ্যে আবার লেবাননে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।


গাজায় চার মাস ছিলেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) একজন চিকিৎসক। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি সিএনএনকে বলেন, গাজার পর এখন অনেক সেনাকে লেবাননে পাঠানো হতে পারে—এই ভয় পাচ্ছেন তাঁরা। ইসরায়েলি বাহিনীর বহু সেনাসদস্য এখন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সরকারকে বিশ্বাস করেন না।

গাজায় সচরাচর বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেয় না ইসরায়েল সরকার। যাঁরা এ সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁদেরও ইসরায়েলি বাহিনীর পাহারা ও নজরদারির মধ্যে থাকতে হচ্ছে। ফলে ইসরায়েলের হামলায় গাজার ফিলিস্তিনিদের কতটা দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে বা সেখানে ইসরায়েলি সেনারা কেমন অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছেন, সে চিত্রটা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

গাজায় লড়াই করা ইসরায়েলি সেনারা সিএনএনকে জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে তাঁরা যে ভয়াবহতা দেখেছেন, তা বাইরের মানুষ সত্যিকার অর্থে কল্পনাও করতে পারবেন না। এই বক্তব্য থেকে উপত্যকাটিতে চলমান নৃশংসতা সম্পর্কে একটা আঁচ পাওয়া যায়। সমালোচকদের ভাষায়—নেতানিয়াহু এই নৃশংসতার নাম দিয়েছেন ‘চিরকালের যুদ্ধ’।

এলিরানকে গাজায় মোতায়েন করা হয়েছিল গত বছরের ৮ অক্টোবর। তাঁর কাজ ছিল ডি–৯ মডেলের একটি বুলডোজার চালানো। ৬২ হাজার কেজি ওজনের এই যানটি গুলি ও বোমা হামলার মুখেও টিকে থাকতে পারে। হামাসের হামলার পর নিজ আগ্রহে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এলিরান। এর আগে তিনি কাজ করতেন দেশটির একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে।

গাজায় ১৮৬ দিন ছিলেন এলিরান। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর বুলডোজারে হামলা চালানো হয়। এতে হাঁটুতে আঘাত পান তিনি। তারপর চিকিৎসার জন্য গাজা থেকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে নেওয়া হয় তাঁকে। এপ্রিলে তাঁকে পিটিএসডির চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয়। প্রতি সপ্তাহেই থেরাপি নিচ্ছিলেন। তবে এই চিকিৎসা তাঁর জীবনে কোনো কাজে আসেনি।

গাজা থেকে ফেরার পর অল্পতে রেগে যেতেন এলিরান, রাতের পর রাত ঘুম হতো না, ঘামতে থাকতেন। পরিবারকে বলতেন, গাজায় তিনি যে কী অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছেন, তা কেবল সেখানে তাঁর সঙ্গে থাকা ব্যক্তিরাই বুঝবেন। এলিরানের বোন শির সিএনএনকে বলেন, ‘সে সব সময় বলত, “আমি যে কী দেখে এসেছি, তা কেউ বুঝবে না।”’

আত্মহত্যা করা এই ইসরায়েলি সেনার মা বলছিলেন, ‘সে অনেককে মারা যেতে দেখেছে। হয়তো কাউকে হত্যাও করেছে। তবে সন্তানদের এসব করার শিক্ষা আমরা দিই না। তাই যখন সে এমন কিছু করেছিল, তখন হয়তো বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিল।’

গুই জাকেন। এলিরানের এই বন্ধু গাজায় তাঁর সঙ্গে বুলডোজার চালাতেন। তিনি এখন মাংস খেতে পারেন না। খাওয়ার সময় গাজায় বুলডোজারের ভেতর থেকে দেখা নানা দৃশ্যের কথা তাঁর মনে পড়ে। ঘুমাতে গেলে একপ্রকার সংগ্রাম করতে হয়। কারণ, তাঁর কানে সব সময় বাজে বিস্ফোরণের শব্দ।

গাজায় যেসব মরদেহ দেখেছেন, সেগুলোকে এখন ‘মাংসের’ মতো মনে হয় গুই জাকেনের কাছে। তিনি বলেন, ‘আপনি যখন বুলডোজারের বাইরে তাঁদের (ফিলিস্তিনি) ও আমাদের (ইসরায়েলি সেনা) প্রচুর রক্ত ও মাংস পড়ে থাকতে দেখবেন, তখন তা সত্যিকার অর্থে আপনার খাবারের ওপর প্রভাব ফেলবে।’

ইসরায়েলের এক সেনা বলেন, ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ‘গাজার বেসামরিক লোকজন খারাপ। কারণ, তারা হামাসকে সাহায্য করে। তাদের গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখে।’

গাজায় বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের মুখোমুখি হলে ইসরায়েলি সেনারা নৈতিকভাবে একধরনের দোটানার মধ্যে পড়েন বলে জানিয়েছেন আইডিএফের একজন চিকিৎসক। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, গাজাবাসীকে নিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে অবিশ্বাসের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ‘গাজার বেসামরিক লোকজন খারাপ। কারণ, তারা হামাসকে সাহায্য করে। তাদের গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখে।’

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ভাষ্যমতে, গাজায় বেসামরিক মানুষের মৃত্যু কমাতে তারা সম্ভাব্য সবকিছু করছে। কোনো হামলার আগে বেসামরিক লোকজনকে সতর্ক করতে খুদে বার্তা পাঠানো হচ্ছে ও ফোন করা হচ্ছে। অনেক জায়গায় আকাশ থেকে সতর্কবার্তা লেখা খুদে বার্তাও পাঠানো হচ্ছে। এরপরও গাজায় বিপুল পরিমাণ বেসামরিক লোকজন নিহত হচ্ছেন। এমনকি নিজেদের ঘোষণা করা ‘নিরাপদ অঞ্চলেও’ হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী।

ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যে গাজার বাসিন্দারাও চরম মানসিক সংকটে ভুগছেন। ১৭ বছর ধরে অবরুদ্ধ থাকা ও ইসরায়েলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ গাজাবাসীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে, তা বারবার তুলে ধরেছে জাতিসংঘ ও ত্রাণ সরবরাহকারী বিভিন্ন সংস্থা।

যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আহরন বার্গম্যান। ১৯৮২ সালে লেবানন যুদ্ধের সময়সহ মোট ছয় বছর তিনি ইসরায়েলি বাহিনীর হয়ে কাজ করেছেন। তাঁর মতে, ইসরায়েল এখন পর্যন্ত যত যুদ্ধ করেছে, তার চেয়ে এবারের যুদ্ধ ভিন্ন। বার্গম্যান বলেন, এবারের যুদ্ধ শহর এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে চলছে। সেনাদের বহু মানুষের মধ্যে লড়তে হচ্ছে। তাঁদের অধিকাংশই বেসামরিক।

বার্গম্যানের ভাষ্যমতে, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর যেসব সদস্য সরাসরি যুদ্ধের মুখে পড়ছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন বুলডোজার চালকেরা। তাঁরা মৃত মানুষ দেখছেন। ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে মরদেহগুলোও তাঁদের বুলডোজার দিয়ে সরাতে হচ্ছে। অনেক সময় মরদেহগুলোর ওপর দিয়েই তাঁদের বুলডোজার চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ইসরায়েলি সেনাদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ ছিল আত্মহত্যা।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ইসরায়েলে ফেরার পর অনেক সেনা সাধারণ জীবনযাপন করতে পারছে না বলে মনে করেন আহরন বার্গম্যান। কারণ, শহুরে এলাকায় এই যুদ্ধে বহু নারী ও শিশু নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘গাজায় শিশুদের নিহত হতে দেখার পর কীভাবে আপনি আপনার সন্তানদের ঘুম পাড়াবেন?’

গাজা থেকে ফেরার পর শুধু এলিরানই নন, ইসরায়েলের আরও অনেক সেনা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ইসরায়েলি বাহিনীর তথ্যের বরাতে দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম হারেৎজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১১ মে পর্যন্ত ১০ জন ইসরায়েলি সেনা আত্মহত্যা করেছেন।

ইসরায়েলি বাহিনীর একজন কমান্ডার ও মনোবিজ্ঞানী উজি বেচোরের কাছে সেনাসদস্যদের আত্মহত্যার সংখ্যার বিষয়ে জানতে চেয়েছিল সিএনএন। তিনি বলেন, ৫–৬ বছর ধরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে আত্মহত্যার হার কমবেশি স্থিতিশীল রয়েছে। বলতে গেলে ১০ বছর ধরে সংখ্যাটা কমছে। তবে সংখ্যাটা সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করেননি এই মনোবিজ্ঞানী।

গাজা যুদ্ধ থেকে ফেরা এক–তৃতীয়াংশ ইসরায়েলি সেনাই মানসিক স্বাস্থ্য–সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছেন। গত আগস্টে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতি মাসে এক হাজারের বেশি আহত সেনাসদস্যকে চিকিৎসার জন্য ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তাঁদের ৩৫ শতাংশ নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অভিযোগ করেছেন। তবে এই সেনাদের ২৭ শতাংশের অবস্থা উন্নতির দিকে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছরের শেষ নাগাদ ১৪ হাজার ইসরায়েলি সেনাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হবেন।

গাজা যুদ্ধ চলাকালে সেনাসদস্যদের আত্মহত্যা–সংক্রান্ত ‘গুজব’ রুখতে চলতি বছরের শুরুর দিকে পদক্ষেপ নিয়েছিল ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তখন সেনাসদস্যদের আত্মহত্যাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেছিল তারা। বলেছিল, আগের বছরের তুলনায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে আত্মহত্যার সংখ্যা কমেছে।

এরপরও এলিরানের আত্মহত্যার জন্য গাজা যুদ্ধকেই দায়ী করছেন তাঁর বোন শির। ভাইয়ের মানসিক যন্ত্রণার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘সেনাাহিনীর কারণে, এই যুদ্ধের কারণে, আমার ভাই আর আমাদের মাঝে নেই। সে হয়তো যুদ্ধে গুলিতে বা আরপিজির (রকেট প্রপেলড গ্রেনেড) আঘাতে মারা যায়নি, তবে অদৃশ্য এক গুলি তার জীবন কেড়ে নিয়েছে।’

সর্বশেষ

জনপ্রিয়