জন্মদাতা বাবাকে পেলেন ফেসবুক বন্ধতালিকায়
বড় একটি শ্বাস টেনে ফোনটা করলেন তমুনা মুসেরিদজে। তাঁকে হয়তো দত্তক নেওয়া হয়েছিল—এ কথা জানতে পারার পর থেকেই এই ফোনালাপের স্বপ্ন লালন করছিলেন তিনি।
ফোনটা তিনি করেছিলেন সেই নারীকে, যিনি তাঁর জন্মদাতা মা বলে তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিল। এই ফোনালাপ হয়তো তাঁকে রূপকথার মতো কোনো পুনর্মিলনী এনে দেবে না, তা তিনি জানতেন। তবে অন্য তরফের প্রতিক্রিয়া এত শীতল ও ক্ষুব্ধ হবে, তেমনটাও তিনি ভাবেননি।
‘তিনি চিৎকার শুরু করেছিলেন। চেঁচিয়ে বলেছিলেন, তিনি কোনো সন্তানের জন্ম দেননি আর আমার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ইচ্ছাই তাঁর নেই,’ বললেন তমুনা। তমুনার মনে আছে, এই প্রতিক্রিয়ায় তিনি যতটা না মন খারাপ করেছিলেন, তার চেয়ে অবাক হয়েছিলেন বেশি।
‘আমি যেকোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু তাঁর প্রতিক্রিয়া আমার সব জল্পনাকল্পনাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।’
তমুনা কিন্তু তখনই হাল ছেড়ে দিতে চাননি। কোন পরিস্থিতিতে তাঁকে দত্তক দেওয়া হয়েছিল, তিনি তা জানতে চেয়েছিলেন। আরেকটি তথ্যও তিনি জানতে চেয়েছিলেন, যা কেবল তাঁর মা-ই তাঁকে জানাতে পারেন—তাঁর বাবার নাম।
যে নারী তাঁকে লালনপালন করেছিলেন তিনি মারা যাওয়ার পর ২০১৬ সালে তমুনার অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল। বাসা খালি করার সময় তিনি তাঁর নিজের নামে একটি জন্মসনদ খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু জন্ম তারিখটি ছিল ভুল। তখন থেকে তিনি সন্দেহ করতে শুরু করেন যে তাঁকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। কিছু খোঁজখবর করার পর তিনি ভেদজেব বা ‘রক্ত–সম্পর্কের পরিবারের সন্ধানে’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ খোলেন।
নিজের পরিবারের খোঁজ পাওয়ার বদলে তিনি জর্জিয়ায় হাজার হাজার মানুষের জীবনকে ওলট-পালট করা একটি শিশু পাচার কেলেঙ্কারির তথ্য উন্মোচন করেছিলেন। বহু দশক ধরে বাবা-মায়েদের সঙ্গে মিথ্যা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে তাঁদের নবজাতক শিশুরা মারা গেছে। তারপর ওই শিশুদের বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।
তমুনা একজন সাংবাদিক। তাঁর কাজ শত শত পরিবারকে পুনর্মিলিত করেছিল। তবে তখন পর্যন্ত তিনি তাঁর নিজের উৎসের রহস্যটি সমাধান করতে পারেননি। তিনিও ছোটবেলায় চুরি হয়ে গিয়েছিলেন কি না, এ প্রশ্ন তাঁকে ভাবাতে থাকে।
তমুনা বলেন, ‘এই গল্পে আমি ছিলাম একজন সাংবাদিক। তবে এটি আমার জন্যও একটি ব্যক্তিগত ব্রত (মিশন) ছিল।’
তমুনা অনুসন্ধান পথের খোঁজ পান এক গ্রীষ্মে, তাঁর ফেসবুক গ্রুপে আসা একটি বার্তায়। জর্জিয়ার গ্রামাঞ্চলের এক বাসিন্দা বার্তাটি পাঠান। তিনি লেখেন, তাঁরা এমন একজন নারীকে চেনেন, যিনি একবার গর্ভবতী হওয়ার কথা গোপন করেছিলেন। নারীটি ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসিতে এক সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। আর ওই সময়েই তমুনা জন্মেছিলেন—এ তারিখই তিনি সবাইকে জানিয়েছিলেন।
লোকটির বিশ্বাস হয়েছিল যে ওই নারী তমুনার জন্মদাতা মা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাঁরা একটি নাম বলেছিলেন।
তমুনা তৎক্ষণাৎ ওই নারীকে অনলাইনে খোঁজাখুঁজি করেন। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাঁকে পান না। তখন তমুনা ওই নারীকে কেউ চেনে কি না, তা জানতে চেয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন।
এক নারী দ্রুত বলেন, যে নারী গর্ভবতী হওয়ার বিষয় গোপন করেছিলেন, তিনি তাঁর নিকটাত্মীয়। তিনি তমুনাকে পোস্টটি সরিয়ে নিতে অনুরোধ করেন, কিন্তু তিনি ডিএনএ পরীক্ষা করাতে রাজি হন।
তাঁরা যখন ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তখনই তমুনা তাঁর মাকে ফোনটি করেছিলেন।
এক সপ্তাহ পর ডিএনএ পরীক্ষার ফল আসে। তাতে দেখা যায়, তমুনা ও ফেসবুকের যোগাযোগ করা মেয়েটি আদতেই কাজিন (তুতো বোন)। এই প্রমাণের জোরে তমুনা তাঁর মাকে সত্য স্বীকার করতে এবং তাঁর বাবার নাম বলতে রাজি করান। এভাবে তমুনা জানলেন, গুরগেন খোরাভা নামের এক ব্যক্তি ছিলেন তাঁর বাবা।
ওই সময়ের কথা স্মরণ করে তমুনা বলেন, ‘প্রথম দুটি মাস ছিল হতবিহ্বল একসময়। আমার জীবনে যে এমনটা ঘটছে, তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি তাঁদের খুঁজে পেয়েছি, তা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।’
গুরগেনের নাম জানার সঙ্গে সঙ্গেই তমুনা তাঁকে ফেসবুকে খুঁজে বের করেন। দেখা গেল যে ওই ভদ্রলোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর গল্পটি দেখে আসছেন। বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ঘটানো নিয়ে তমুনার কাজ জর্জিয়াজুড়ে সুপরিচিত।
তমুনা দেখে অবাক হলেন যে ‘তিন বছর ধরে তিনি (গুরগেন) তাঁর বন্ধুতালিকায় রয়েছেন’। তারপরও গুরগেনও যে তাঁর গল্পের অংশ, তা তিনি বুঝতে পারেননি। তমুনা বলেন, ‘আমার জন্মদাত্রী মা যে গর্ভবতী হয়েছিলেন, তিনি তা-ও জানতেন না। এ খবর তাঁর জন্য ছিল বিশাল এক বিস্ময়।’
তাঁরা দ্রুত গুরগেনের নিজের শহর পশ্চিম জর্জিয়ার জুগদিদিতে তাঁর বাসায় দেখা করলেন। তমুনা থাকেন রাজধানী তিবিলিসে। সেখান থেকে এই শহরের দূরত্ব প্রায় ২৬০ কিলোমিটার।
পেছন ফিরে তাকিয়ে তমুনার মনে হলো, তিনি একটি হতবিহ্বল অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু যখন তিনি গুরগেনের বাগানের ফটকের দিকে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি আশ্চর্যজনক এক প্রশান্তি অনুভব করেছিলেন।
যখন ৭২ বছর বয়সী গুরগেনের সামনে এলেন, তাঁরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর একমুখ হাসি নিয়ে একে অন্যকে দেখার জন্য একটু থামলেন।
তমুনা বলেন, ‘আজব লাগছিল যে আমার দিকে তাকানোমাত্রই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, আমি তাঁর মেয়ে। আমার মনে তখন নানা রকম আবেগ উথাল–পাতাল করছিল।’
তমুনার মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু কোথায় থেকে শুরু করবেন, তা বুঝতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, ‘আমরা কেবল একসঙ্গে বসেছিলাম, একে অন্যকে দেখছিলাম এবং নিজেদের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম।’