বাংলা সাহিত্যের দূত উইলিয়াম রাদিচে আর নেই
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু কবিতা, গল্প এবং মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ যার তর্জমায় ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠক মহলে পৌঁছে গিয়েছিল অনায়াসে, সেই কবি, গবেষক ও অনুবাদক, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ‘স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’-(সোয়্যাস) এর বাংলা ভাষার অধ্যাপক উইলিয়াম রাদিচে আর নেই।
সোমবার নর্থ ইংল্যান্ডে রাদিচের মৃত্যু হয়; তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। স্ত্রী এলিজাবেথ ও দুই কন্যা রয়েছে তার।
তার চলে যাওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী কবি কায়সার হক।
তিনি বলেন, “নিউ ক্যাসলে থাকতেন রাদিচে। জীবনের শেষ এক দশকের বেশি সময় নর্থ ইংল্যান্ডে থাকতেন । সেখানে থেকেই তিনি চলে গেলেন।“
এক দশক আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ায় রাদিচে তার লেখালেখির ‘ক্ষমতা হারিয়েছিলেন’ বলে আক্ষেপ করছিলেন কায়সার।
এক সময়ের ঘনিষ্ঠ রাদিচের সঙ্গে বহুকাল সরাসরি দেখাসাক্ষাৎ না হলেও টেলিফোন তারা কথা বলেছেন, একজন আরেকজনের খোঁজখবর করেছেন।
কায়সার বলেন, “যতদূর মনে পড়ে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাদিচের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। শামসুর রাহমানের কিছু কবিতা আমি অনুবাদ করেছিলাম। রাদিচে সেসবের কিছু রিভিউ লিখেছিলেন, পত্রিকাতে প্রকাশও হল। কদিন আগেও রাদিচের কথা ভেবেছিলাম। কি আশ্চর্য, এখন তার মৃত্যুর কথা বলতে হচ্ছে।”
১৯৫১ সালে জন্ম নেওয়া রাদিচের মা বেটি রাদিচেও ছিলেন ধ্রুপদী ল্যাটিন সাহিত্যকর্মের অনুবাদক ও সম্পাদক। তার পূর্বপুরুষ যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন ইটালি থেকে।
সত্তরের দশকের গোড়ায় রাদিচে অক্সফোর্ডে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়া শুরু করেন। তার এক বছর আগে তিনি ভারতের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন, সেই সুবাদে কলকাতা, দিল্লি, বেনারস, চেন্নাইয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
ভারত সফরের আগেই পরিচালক লেখক আঁকিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা রাদিচের ভেতরে মুগ্ধতা তৈরি করে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি তার আগ্রহ ছিল যুবক বয়স থেকেই।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে (সোয়্যাস) বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন রাদিচে। সেখানকার অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে বাংলা শিখে তার শিষ্য হয়ে উঠেছিলেন। সেখানকার কারো কারো ধারণা, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও রাদিচেকে আলোড়িত করেছিল, বাংলা ভাষার প্রতি তার আগ্রহ বাড়ার এটাও একটা কারণ।
পরে সোয়্যাসের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন রাদিচে। কথায় কথায় কায়সার হক বললেন, রাদিচের প্রতিভা ‘মনে রাখার মত’।
কায়সার বলেন, “এমন বাজে একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল।একটি ট্রাক ওর গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছিল। প্রথম দিকে তো রাদিচের মস্তিষ্ক একদম সাড়া দিত না। পরে শুয়ে বসে পড়াশোনাটা করতেন।“
কায়সার জানান, যে বাংলার প্রতি এত মায়া ছিল রাদিচের, সেই ভাষা তিনি একসময় ভুলতে বসেন।
তিনি বলেন, “ একসময় স্মৃতিশক্তি তেমন কাজ করত না। স্মৃতি বিভ্রমও শুরু হয়েছিল। দুঃখের কথা হল, বাংলা ভাষাটা সে ভুলে যায়। আমাকে ফোন করে কী যে দুঃখ করে বলছিলেন রাদিচে! আফসোস হল, অনেকদিন আর কথাও হয়নি।”
কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেন, “খবরটা পেয়ে খুবই খারাপ লাগছে। বিশ শতকের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বহির্বিশ্বে নতুন করে আগ্রহ সঞ্চারের নেপথ্যে রাদিচের তর্জমায় কবিতাগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।”
কলকাতায় রবীন্দ্রসংগীত গবেষক দেবাশিস রায়চৌধুরীর সঙ্গেও রাদিচের বহু বছরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
দেবাশিস বলছেন, ২০১২ নাগাদ কলকাতায় ইংরেজিতে ‘রাজা’ নাটকে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রাদিচে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবিত ও মৃত’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’র ভাষান্তর ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’, ‘লিখন’, ‘স্ফুলিঙ্গ’র অণুকবিতাগুলি নিয়ে রাদিচে লেখেন ‘পার্টিকলস, জটিংস, স্পার্কস’।
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ইংরেজি ভাষান্তরের মূল পাণ্ডুলিপি নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজও করেছেন রাদিচে। অনুবাদ করেছেন রবি ঠাকুরের ৩০টি গল্প, যা প্রকাশ হয়েছিল পেঙ্গুইনে।
রাদিচের ভাষান্তরে ‘দেবতার গ্রাস’ (স্ন্যাচড বাই দ্য গডস)-এর অপেরাধর্মী উপস্থাপনা করেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সুরকার পরম বীর।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির বই’ও ভাষান্তরের জন্য বেছে নিয়েছিলেন রাদিচে। ‘টুনটুনির বই’ তার হাতে হয়ে ওঠে ‘দ্য স্টুপিড টাইগার অ্যান্ড আদার টেলস’।
তিনি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নিয়ে গবেষণা করেন। তর্জমাও করেন ‘দ্য পোয়েম অব দ্য কিলিং অব মেঘনাদ’।
এছাড়া ইংরেজিতে লেখা কবিতা, প্রবন্ধ ও সম্পাদনাকর্মের বিপুল সম্ভার রেখে গেছেন উইলিয়াম রাদিচে।