বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪ , ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বিবিসি

প্রকাশিত: ০৮:৫৮, ৯ জুন ২০২৪

বেনজীরের রিসোর্ট ও পার্ক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে, এসব সম্পত্তির ভবিষ্যৎ কী

বেনজীরের রিসোর্ট ও পার্ক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে, এসব সম্পত্তির ভবিষ্যৎ কী

বাংলাদেশের পুলিশের একজন সাবেক মহাপরিদর্শক বা আইজিপি বেনজীর আহমেদের মালিকানাধীন সাভানা রিসোর্ট ও ন্যাচারাল পার্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসন। এখন থেকে এই সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রশাসনই পালন করবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।


“আদালত ক্রোকাদেশ দিয়েছে। তার অংশ হিসেবে আজ আমরা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে এসেছি। অর্থাৎ ওই সম্পত্তি আমরা আমাদের হেফাজতে নিলাম। এখন এর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সরকারি হেফাজতে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম।

গত তেইশে মে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা এক আবেদনের প্রেক্ষিতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দেয় ঢাকার একটি আদালত।

দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান তখন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন যে "মোট ৮৩ টি দলিলের প্রোপার্টি, বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে এই তালিকায়। কক্সবাজারের একটি প্রোপার্টি রয়েছে"।

তবে মি. আহমেদের সম্পদের বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান এখনো চলছে। অনুসন্ধান শেষ হলে তার মোট সম্পদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে আইনজীবীরা ধারণা দিয়েছেন। মূলত ওই অনুসন্ধান রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই দুদক মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে।

এর মধ্যে মি. আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকে ডাকা হলেও তিনি আরও সময় চেয়ে আবেদন করেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

২০২২ সালের ত্রিশে সেপ্টেম্বর আইজিপির পদ থেকে অবসরে গিয়েছিলেন মি. আহমেদ। পরে সম্প্রতি ঢাকার একটি পত্রিকায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাপক সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করে রিপোর্ট প্রকাশ করলে তা নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় হয়।

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ পরে ফেসবুক লাইভে এসে তার নামে প্রকাশিত সব সংবাদকে অসত্য দাবি করেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সব অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। কর্মজীবনে পাঁচবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ছাড়াও নীতি নৈতিকতার জন্য শুদ্ধাচার পুরস্কারেও তাকে ভূষিত করেছিল সরকার।

তবে এর মধ্যে দুদকের আরেক আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ছয়ই জুন মি. আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের ক্রোক করা স্থাবর সম্পদ দেখভালে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দেয় আদালত। আদালতের পূর্ণাঙ্গ আদেশ আসার পর কোন সম্পদ কারা দেখভাল করবে সেটি বিস্তারিত জানা যাবে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।

সেটি পাওয়ার পরই পুকুর, জমি-জমাসহ ক্রোকাদেশের আওতায় থাকা অন্য সম্পদগুলোর বিষয়ে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়কের ব্যবস্থাপনায় দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম।

যেভাবে নিয়ন্ত্রণ নেয়া হলো এবং এ সম্পত্তির ভবিষ্যৎ কী

গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম জানিয়েছেন, প্রায় ছয়শ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা সাভানা রিসোর্ট ও ন্যাচারাল পার্কের সব কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং এ থেকে যা আয় হবে সেটি সরাসরি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে।

পরবর্তীতে আদালত যেভাবে আদেশ দেবে এ সম্পদের ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনা সেভাবেই হবে, বলছিলেন তিনি।

এর আগে শুক্রবার রাতেই পার্কের প্রধান গেইটের সামনে মাইকিং করে জেলা প্রশাসন ও দুদক যৌথভাবে সম্পদটি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ঘোষণা দেয়। পরে তারা পার্কে প্রবেশ করে এর নিয়ন্ত্রণ বুঝে নেয়।

শনিবার সকাল থেকে এটি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের নিয়ন্ত্রণে ও হেফাজতে আছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক। ওই পার্কের ভেতরে জমি, পুকুরসহ আরও যেসব স্থাপনা আছে সেগুলোর ব্যবস্থাপনাও আদালতের আদেশের ভিত্তিতে হবে বল জানিয়েছেন তিনি।

তবে আদালতের নির্দেশে রাষ্ট্র যখন কোন সম্পদ জব্দ করে তার কী হয় বা এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আইন কী বলে, এমন প্রশ্নের জবাবে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন আদালত জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে, সে কারণে পরবর্তী অন্য কোন নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এই সম্পদ জব্দ অবস্থাতেই থাকবে।

“জব্দ সম্পত্তিতে কিছু করতে হলে আদালতের অনুমতির দরকার হয়। আদালত একটি আদেশ দিয়েছে। সে অনুযায়ী এগুলোর কার্যক্রম চলবে। জব্দ হওয়া সম্পত্তি থেকে যা আয় হবে সেটি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে,” বলছিলেন মি. খান।

আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত আদালত বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের যে সব সম্পদ জব্দ বা ফ্রিজ করার নির্দেশ দিয়েছেন তার মধ্যে আছে ঢাকার গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক হিসেব, তিনটি শেয়ার ব্যবসার বিও অ্যাকাউন্ট, প্রায় ৬২১ বিঘা জমি, উনিশটি কোম্পানির শেয়ার এবং ত্রিশ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র।

এছাড়া তদন্তকারীরা ঢাকা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও কক্সবাজারে বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের মালিকানাধীন জমির সন্ধান পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১১২ একর জমি তার নিজ জেলা গোপালগঞ্জে।

পাশাপাশি মি. আহমেদ বা তার পরিবারের সদস্যদের বিদেশে সম্পদ আছে কি না, তা জানতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি দিয়েছে দুদক।

১৯৮৮ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া মি. আহমেদকে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী আইজিপি’।

পুলিশের শীর্ষ পদে থাকা অবস্থায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন বেনজীর আহমেদ। যদিও তিনি নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যার' মত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সম্পৃক্ততা’র জন্য।

জোর করে নেয়া জমি ফেরত পাবার আইনি বিধান কী

বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার নামে থাকা জমির তথ্য উঠে আসে দুদকের অনুসন্ধানে। তখন অনেকেই অভিযোগ করেন যে তারা চাপের মুখে মি.আহমেদের নামে জমি লিখে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

যদিও মি. আহমেদ তার ফেসবুক লাইভে তার বিরুদ্ধে সংবাদ মাধ্যমে আসা সব অভিযোগকেই মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন। অবসরের পরে তাকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণের চেষ্টা 'হতাশাজনক ও দুঃখজনক' বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বিশেষ করে সাভানা রিসোর্ট ও পার্কের জন্য জোর করে জমি নেয়া হয়েছে বলে স্থানীয়রা অনেকে সংবাদ মাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন। তাদের এক দল ওই পার্কের সামনে বিক্ষোভও করেছে।

দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, কেউ যদি কারও জমি জোর করে দখল রাখে তাহলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি থানায় গিয়ে ফৌজদারি অভিযোগ করতে পারেন এবং প্রয়োজনে সিভিল কোর্টে গিয়েও বলতে পারেন যে তার জমি জোর করে দখল করে রাখা হয়েছে।

“কিন্তু কেউ যদি দলিল করে দিয়ে থাকেন তাহলে তিনি যে চাপের মুখে বাধ্য হয়েছেন বা তাকে দলিল দিতে যে বাধ্য করা হয়েছে সেটি প্রমাণ করতে হবে আদালতে,” বলছিলেন তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন জমি নিয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আইনি প্রতিকারের অনেক উপায় আছে।

“কিন্তু দেখতে হবে যে কোন প্রেক্ষাপটে এবং কোন ক্ষেত্রে তিনি কী বলছেন। সে অনুযায়ী যথাযথ আইনের আওতায় প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে। এটি একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে”।

সম্পদ জব্দ ও রিসিভার নিয়োগের কিছু ঘটনা

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার পর তাদের সম্পদ জব্দ করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব সম্পদের দেখভালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক বা রিসিভার নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো।

২০১২ সালেই আদালতের ক্ষমতাবলে পুলিশকে বহুল আলোচিত হলমার্কের স্থাবর সম্পত্তি দেখভালের জন্য ‘ইনস্ট্যান্ট রিসিভার’ বা ‘তাৎক্ষণিক তদারককারী’ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

আরেক আলোচিত কোম্পানি ডেসটিনির নামে ঢাকায় যেসব সম্পদ রয়েছে তার রিসিভার হিসেবে কাজ করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। এর বাইরে জেলা পর্যায়েরও এ কোম্পানির সম্পদগুলো আংশিকভাবে দেখাশোনা করছেন জেলা পুলিশ সুপার।

ফলে ঢাকাসহ অন্যান্য জায়গার তিনটি সিনেমা হল, অর্ধশতাধিক ফ্ল্যাট ও অর্ধশত গাড়ির মালিকানা ছিলো পুলিশের হাতে।

২০১২ সালের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডেসটিনির ২৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে দুদক। ৪ হাজার ১১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও ৯৬ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে। সেই মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন।

এক সময়ের আলোচিত কোম্পানি যুবকের বিরুদ্ধে গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠেছিলো।

পরে এ বিষয়ে সরকার যে কমিশন গঠন করেছিল তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা দেশে বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠানটির ৯১ খণ্ড জমি, ১৮টি বাড়ি ও ১৮টি কোম্পানি রয়েছে। কিন্তু নানা আইনি জটিলতায় এগুলো বিক্রি করতে পারেনি সরকার।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়