নির্বাচন নাকি সংস্কার
বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা ও ঘনিষ্টজনদের বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে এই সরকার সংস্কার আগে নাকি আগে নির্বাচন এই নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় আছেন। বেশ আগে সেনা প্রধানের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বেশ আলোচনা হয়, যেখানে তিনি বলেছিলেন, দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর আইন উপদেষ্টাও একবার বললেন যে, ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সম্প্রতি লন্ডন সফরে গিয়ে আরেক উপদেষ্টা বললেন, নির্বাচন হবে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি। এছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময় সম্পর্কে তাদের আকাঙ্খার কথাও ব্যক্ত করেছেন।
বিভিন্ন জনের বিভিন্ন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব জানিয়েছেন যে, প্রধান উপদেষ্টা ছাড়া আর যারাই নির্বাচনের সময় বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন সেগুলি তাদের ব্যক্তিগত মতামত। নির্বাচন কবে হবে তার চূড়ান্ত সময় ঘোষণা করবেন ড. ইউনূস। এর আগে এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস অবশ্য বলেছেন যে, রাজনীতিবিদরা যদি সংস্কারের আগেই নির্বাচন চান তবে সেটার আয়োজন করতেও তিনি রাজী আছেন।
রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তনের যে কথা উপদেষ্টারাসহ আরো কেউ কেউ বলছেন তার জন্য জাতীয় সংসদের বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না। যেহেতু এই সরকার বর্তমান সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছেন, ফলে তাদের যে কোন কার্যক্রমের বৈধতা নির্ভর করে এই সংবিধানের বিধান মেনে চলার উপর। যদি তা-ই হয়, তাহলে নির্বাচন পরিচালনাকেই অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এবং পরে নির্বাচিত সংসদ প্রয়োজনীয় সব পরিবর্তন সংসদীয় রীতিনীতির নিয়ম মেনে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো কার্যকর করতে পারবেন।
বলাবাহুল্য, সংস্কার কোন স্বল্পমেয়াদী কার্যক্রম নয়। একগুচ্ছ আইন করেই রাষ্ট্র পরিচালনায় বদল আনা সম্ভব নয়। জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। নইলে তা টেকসই হয় না। এর জন্য দশকের পর দশক আইন প্রণয়নের পাশাপাশি অংশগ্রহনমূলক আলোচনা পর্যালোচনা মাধ্যমে জনমানসের সংস্কারেরও প্রয়োজন হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পেরিয়ে গেলেও এই সরকার এখনো খুব বড়ো রকমের কোন সফলতা দেখাতে পারেননি। দ্রব্যমূল্য, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে অসন্তোষ দানা বেধে আছে। পত্রিকার পাতায় যেসব সংবাদ বড় শিরোনাম পায় তার অধিকাংশই হচ্ছে দুঃসংবাদ।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের অধিকাংশ মানুষ নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ জানার ব্যাপারে উৎসুক হয়ে আছে বলে আমাদের ধারণা। রাজনৈতিক সচেতনতা কম-বেশি যা-ই থাকুক না কেন, দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের বিষয়ে সবাই একমত। কাজেই সংস্কার কার্যক্রমের অজুহাতে নির্বাচন কার্যক্রমকে থামিয়ে রাখা কিংবা তাঁর গতি শ্লথ করা সমীচীন নয়।
ড. ইউনূস রাজনীতিবিদ নন। তিনি একসময় নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর করতে পারেননি। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে তাঁর চিন্তা-চেতনা এবং কাজকর্ম মিলবে না। মানুষের প্রত্যাশার পারদ যে দিনে দিনে উত্তপ্ত হয়ে তা হতাশায় নিমজ্জিত না হয়, সেদিকে এই অন্তর্বর্তী সরকারের দায় অনেক। আশা করব, তিনি জনগণের মনের কথা পড়তে পারেন, মানুষের আশা-প্রত্যাশার মূল্যায়ন তিনি সঠিকভাবে করবেন।
উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে কারও কারও অতি-উৎসাহের কারণে কোনো কোনো কর্মসূচি কিংবা ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনায় অতিরিক্ত আশাবাদ ব্যক্ত করার একধরনের প্রবণতা দেখা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকাল কত মাস বা কত বছর হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন রকম কথাবার্তা হচ্ছে, তাতে করে জনগণের পরিষ্কার কোনো ধারণা তৈরি না হয়ে বেড়ে যাচ্ছে সংশয়।
এখন দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থায় কবে নাগাদ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, তা নিশ্চিত নয়। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করার প্রস্তুতির জন্যও যথেষ্ট সময় প্রয়োজন হবে। নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট কৌতূহল আছে। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোট দিতে পারেননি। ভোট নিয়ে মানুষ আশাহত এবং নিরুৎসাহিত ছিল দীর্ঘকাল। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের মানুষের মধ্যে ভোট উৎসবে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে বলে মনে হয়।
এদিকে স্থানীয় সরকারের কমিশনার ও চেয়ারম্যানদের মধ্যে অনেকে আত্মগোপন করে নিজেদের বাড়িঘর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাতে করে স্থানীয় সরকারের সেবাদান বিঘ্নিত হচ্ছে। জনগণ তাদের নাগরিক অধিকার এবং প্রয়োজনীয় স্থানীয় সেবা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব কারণে অনেকে মনে করছেন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন আগে পরিচালনা করে তারপর জাতীয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। আবার কেউ কেউ স্থানীয় এবং জাতীয় উভয় নির্বাচন একই সঙ্গে করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা কতখানি কার্যকর আলোচনা করতে পারছেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য তুলনামূলকভাবে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে সময় কাটিয়ে দেওয়া বড় কোনো কাজ না। আলোচনার পাশাপাশি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াই মূল কাজ বলে বিবেচনা করি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের সংশোধন এবং পরিমার্জনও প্রয়োজন হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠান কার্যকর করার জন্য আনুষঙ্গিক যে কাজকর্ম, তা নির্বাহ করতেও যৌক্তিকভাবে কয়েক মাস সময়ের প্রয়োজন হবে। সংসদে নারী কোটা ১০০-তে উন্নীত করা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটদানের কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে, নির্বাচনে কালো টাকার দৌরাত্ম্য কমাতে এই সরকার উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে পারে। নির্বাচনে এইসব কাঠামোগত পরিবর্তন করার বিরাট এক সুযোগ এই সরকারের সামনে আছে।
নির্বাচিত সংসদ আগামীতে সংসদীয় রীতিনীতির নিয়ম মেনে প্রয়োজনীয় সব পরিবর্তন ও সংস্কার প্রস্তাব কার্যকর করতে পারবে। এমনিতেই মেঘে মেঘে যে বেলা হয়েছে তাতে করে জট বেঁধে আছে রাষ্ট্রের অনেক ইস্যু, সেসব জট খুলতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।