১৯৭১ এবং ২০২৪ এক নয়
১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটেছিল। ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রতিরোধ যুদ্ধের ডাক দেন।
পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে যে বাঙালি জাতি অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারবে না– এটা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই বোঝা গিয়েছিল। শুরু হয়েছিল বাঙালির মুক্তি আন্দোলন সংঘটনের নানামুখী তৎপরতা। এরই ধারাবাহিকতায় ২৪ বছরের নানামুখী সংগ্রামের পর ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে।কিন্তু বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানিদের অনীহা ছিল। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শুধু ঢাকা নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও বেরিয়ে আসে পথে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখ পাকিস্তানি বাহিনী রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতির ওপর। শুরু হয় যুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ। নিরস্ত্র বাঙালি জাতি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের মুখে যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে যোদ্ধায় পরিণত হয়েছিল। তারপর নয় মাস জুড়ে বাঙালি জাতি রচনা করেছিল এক নতুন ইতিহাস ।
২.
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পরাজয়ে আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছিল। কিন্তু গত ৫৩ বছরে সামাজিক অগ্রগতির নানা সূচকে আমরা প্রতিবেশী অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে গেলেও অনেকে ক্ষেত্রেই এখনো আমরা পিছিয়ে আছি। দেশে এখনো রাজনৈতিক স্থিরতা আসেনি। যে গণতন্ত্রের আকাঙ্খায় এই দেশের পত্তন সেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার মানসিকতা তৈরি হয়নি। দুর্নীতিবাজ লুটপাটকারীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। দেশে ধনবৈষম্যও প্রকট হয়েছে। কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। সব মানুষের জন্য সমান নিরাপদ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি।
যে কারণে বারবার হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ড, জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড, হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন, ৯০ এর গনঅভ্যুত্থান, এক/এগারো, ২৪ এর জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান... একের পর পর চড়াই-উৎরাই চলছেই। কষ্টের শেষ নেই, নেই। অথচ কথা ছিল, "একটি পতাকা পেলে, আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে।"
৩.
১৯৭১ এ কাঙ্খিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি বলেই এদেশের মানুষ হাল ছাড়েনি। গত শতকের আশির দশক জুড়ে আন্দোলন লড়াই করে ১৯৯০-এ গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। বিগত সরকারের নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে তারা ২০২৪-এ এসেও।
বিগত শাসনামলে জনমনে এমন অনুভূতি জেগেছে যে শাসকগোষ্ঠীই রাষ্ট্রের সব, জনগণ আশা-আকাঙ্খার কোন মূল্য নেই। উপেক্ষা এদেশের মানুষ সহ্য করে না। নব্বইয়ে জনগণ লড়েছে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। চব্বিশে জনগণ লড়াই করেছে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে গড়ে উঠা এক তীব্র স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে, সকল ধরনের বৈষম্য বিলোপের আশায়।
স্বাধীনতার এতো দিন পরেও যে দেশের জনগণের যে মুক্তি এলো না তার পেছন কাজ করেছে মূলত রাজনৈতিক ব্যর্থতা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো কাঠামো দাঁড় করানো গেল না। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা গেল না রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র। এই মৌলিক বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের অস্থিরতা কমবে বলে মনে হয় না। আবারো ৯০ বা ২৪ এসে হাজির হবে নতুন রুপে।
৪.
চব্বিশকে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এবং নতুন বাংলাদেশ। আন্দোলনের শুরুর দিকে মনে হতো হয়তো এটা রূপকার্থে বলা হচ্ছে। কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে তা বিশেষ অর্থারোপ করেই বলা হচ্ছে। একাত্তর-এর মহিমাকে কিছুটা ম্লান করে দেখার অপচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি যথেষ্ট গুরুত্ব ও সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুকে হেয় করাই যেন বিশেষ লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, একাত্তরকে ছোট করতে না পারলে বা পেছনে ফেলতে না পারলে চব্বিশকে বড় করা যাচ্ছে না।
মুক্তিযুদ্ধের মৌলআকাঙ্ক্ষা ছিল পাকিস্তানি শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে একটি নতুন দেশের ঠিকানা। একাত্তর হলো দেশের প্রশ্ন, সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, মানচিত্রের প্রশ্ন। চব্বিশ হলো এক নিপীড়ক স্বৈরশাসকের উচ্ছেদের লড়াই।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১, ১৯৯০ এবং ২০২৪ স্বকীয় ধারায় বহমান। সাদৃশ্য রয়েছে, তবে বৈসাদৃশ্য কম নয়।
চরিত্রগতভাবে দুটো সংগ্রামের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষের মুক্তির প্রশ্ন। দুটোই নিপীড়নমূলক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ মানুষের বাঁধ ভাঙ্গার গল্প। স্পিরিটের দিক থেকে সাজুয্যতার আরেকটি জায়গা হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও বৈষম্যবিরোধী সামাজিক ন্যায়বিচারের আকুতি।
তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় ১৯৭১ এবং ২০২৪ এক নয়। ১৯৭১ হলো বাংলাদেশের ভিত্তিভূমি আর ২০২৪ হলো চলার নতুন নিশানা। একটির সঙ্গে আরেকটির তুলনা হয় না। কিন্তু অনেকে তুলনা করছেন। তুলনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন নানা কারণে, ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে।
প্রকৃত প্রস্তাবে, আমাদের স্বাধীনতা একটাই যা অর্জিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। অন্যান্য সকল আন্দোলন, সংগ্রাম ও অর্জন কোনো অর্থেই ১৬ ডিসেম্বরের সঙ্গে তুলনাযোগ্য নয়। এর অর্থ এ নয় যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান তুচ্ছ কোন ঘটনা। এটিও আমাদের অত্যন্ত উঁচুমানের অর্জন। বাঙালি তার অধিকারের প্রশ্নে যে নিয়ত জেগে আছে– ৯০ কিংবা ২৪ এর অভ্যুত্থান তা প্রমাণ করে।
৫.
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ সংশয় আর আস্থাহীনতায় ভরা। এ পেছনে মূলত কাজ করে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার মনোবাসনা। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে ক্ষমতাবান হওয়াটাই মুখ্য। সেই অর্থে এখানে কোনো পরিশীলিত রাজনৈতিক চর্চা গড়ে উঠেনি। জনবান্ধব রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টাটি তাই বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে।
গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, ইসলাম, অন্তর্ভুক্তি, বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ- রাষ্ট্রনীতিতে এগুলোর স্পষ্টীকরণে দীর্ঘদিন ঘুরপাক খাচ্ছে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক কোনো বোঝাপড়া নেই। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি কী হবে ওই বিভক্তি রাজনীতিতে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছে।
এই অনৈক্যের সুবাদে একাত্তরে যারা পরাজিত হয়েছিল তারা বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিল। তারা ছিল গণবিরোধী, শোষক, ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক এবং স্বৈরাচারী। আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম এসব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই। আমাদের যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার, মুক্তির। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, একটি জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকার সঙ্গে আমরা সেদিন শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য থেকেও মুক্তি চেয়েছিলাম।
কিন্তু সেই মুক্তি আসেনি। সবচেয়ে বড় কথা দেশে স্বাধীনতার এত বছর পরও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়নি। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এত বছর পরে এসেও নড়বড়ে দেখতে হচ্ছে। গত দেড় দশকে ভোটের ব্যবস্থাও বিতর্কিত হয়েছে। দেশ পরিণত হয়েছে দুর্নীতিবাজ ও টাকা পাচারকারীদের স্বর্গ রাজ্যে। বিরুদ্ধমত দমনের একপেশে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীর সরকার বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছে। রাজনীতি কবে সুস্থ ধারায় ফিরবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।
সব থেকে বড় বিপদের কথা হলো, পরাজিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদর্শনে বিশ্বাসী মানুষের আনাগোনা প্রবলভাবে বাড়ছে। ধর্ম আর যার যার বিশ্বাসের বিষয় না থেকে রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠছে। যেসব ক্ষত থেকে মুক্তির জন্য দেশের অগণন মানুষ জীবন ও সম্ভ্রম দিয়েছেন, সে ক্ষতই আবার বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতির জন্য এটা চরম লজ্জা ও অপমানের।
কেউ এটা মানতে না চাইলেও সত্য হলো, শত্রুরা ঐক্যবদ্ধ। আর আমাদের চলছে নানা মতে, নানা পথের দলাদলি। একাত্তরে যারা একসঙ্গে ছিলাম এখন তারা বিভক্ত। এবারের বিজয় দিবস কি আমাদের ভ্রান্তিমোচনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে? রাষ্ট্রক্ষমতায় কারা আছেন সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তেমনি দেশ কোন নীতি-আদর্শ দ্বারা চালিত হচ্ছে, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। ক্ষমতাসীনদের হাত ধরেই আমরা সমতা-সাম্যের বাংলাদেশে পৌঁছতে চাই। যে স্বপ্ন মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল। ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা মহলবিশেষের প্ররোচনায়-কোনো ভাবেই সে লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাওয়া যাবে না। একাত্তরের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে আমরা যেন বিচ্যুত না হই- এটাই হোক এবারের বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।