মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ১ আশ্বিন ১৪৩১

স্পোর্টস ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৯:৪৬, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আপডেট: ০৮:৫৩, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ধ্বংসযজ্ঞ থেকে স্বপ্নময় দিন

ধ্বংসযজ্ঞ থেকে স্বপ্নময় দিন

ধ্বংসযজ্ঞ যতই ব্যাপক হোক, গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ আসে। বিপদ যতই তীব্র হোক, সম্ভাবনার হাতছানি থাকে। লিটন কুমার দাস ও মেহেদী হাসান মিরাজ তা দেখালেন আরও একবার। ধ্বংসস্তুপের দুঃস্বপ্নেই দারুণভাবে স্বপ্নের সৌধ গড়ে তুললেন দুজন। গড়লেন ইতিহাস, নাম তুললেন রেকর্ড বইয়ে। সকালের আঁধারকে পেছনে ফেলে আলো ঝলমলে দিন কাটাল বাংলাদেশ।

রেকর্ডময় দিনে স্মরণীয় এক সেঞ্চুরি উপহার দিলেন লিটন। স্বপ্নময় সময়ে থাকা মিরাজ নিজের জাত চেনালেন আরও একবার। টপ ও মিডল অর্ডার বিধ্বস্ত হলেও রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে দারুণ লড়াই করে বাংলাদেশ জিইয়ে রাখল জয়ের সম্ভাবনা।

টেস্টের তৃতীয় দিনে ফলো-অনের শঙ্কায় থাকা বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত প্রথম ইনিংসে তোলে ২৬২ রান। একসময় বড় লিডের আশায় থাকা পাকিস্তান লিড পায় কেবল ১২ রানের।

২৬ রানে ৬ উইকেট হারানো দলকে খাদের কিনারা থেকে উদ্ধার করেন লিটন ও মিরাজ। চতুর্থ টেস্ট সেঞ্চুরিতে ১৩ চার ও ৪ ছক্কায় ১৩৮ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেন লিটন।

আগের দিন বোলিংয়ে ৫ উইকেট শিকার করা মিরাজ এবার ব্যাট হাতে খেলেন ৭৮ রানের ইনিংস। ৩০ রানের কমে ৬ উইকেট হারানোর পর আটে নেমে টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ ইনিংস এটি।

দুজনের ১৬৫ জুটিতে গড়া হয় অনন্য কীর্তি। ৫০ রানের নিচে ৬ উইকেট হারানোর পর টেস্ট ইতিহাসের প্রথম দেড়শ রানের জুটি এটিই।

আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখে হাসান মাহমুদের পারফরম্যান্সও। দশ নম্বরে নেমে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার ব্যাটিংয়ে লিটনকে সেঞ্চুরিতে যেতে সহায়তা করার পাশাপাশি মহামূল্য এক জুটি গড়ে তোলেন তিনি। এরপর জ্বলে ওঠেন নিজের আসল কাজেও। শেষ বিকেলে দুই ওভার বোলিংয়েই দুটি উইকেট আদায় করে নেন তিনি।

পাকিস্তান দিন শেষ করে ২ উইকেটে ৯ রান নিয়ে। দিনের শেষটাও দুর্দান্ত করে বাংলাদেশ।

অথচ দিনের শুরুটা ছিল বাংলাদেশের জন্য আতঙ্ক জাগানিয়া। দিনের প্রথম ১০ ওভারের মধ্যে হারায় তারা ৬ উইকেট।

রাউন্ড দা উইকেট অ্যাঙ্গেল কাজে লাগিয়ে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়েন খুররাম শাহজাদ। সুইং বোলিংয়ে নাজেহাল করে ছাড়েন মির হামজা। বাংলাদেশের প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের পাঁচজনই আউট হন শরীরের ভারসাম্যে গড়বড় করে।

আম্পায়ার আউট না দেওয়ায় ও পাকিস্তান রিভিউ না নেওয়ায় জাকির হাসান বেঁচে যান ১ রানে। কিন্তু পরের ওভারেই শাহজাদের লেগ স্টাম্পে থাকা বলে ক্যাচ দেন তিনি আলতো শটে।

শাহজাদের পরের ওভারে পায়ের পেছন দিয়ে বোল্ড হন সাদমান ইসলাম, দুই বল পর ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে বোল্ড নাজমুল হোসেন শান্ত। এই নিয়ে টানা আট টেস্ট ইনিংসে ২০ ছাড়াতে পারলেন না বাংলাদেশ অধিনায়ক।

এই জোড়া ধাক্কার পর দলের বিপদ আরও বাড়িয়ে মুমিনুল হক ফেরেন ক্যাচ অনুশীলন করিয়ে। মির হামজার দুর্দান্ত ডেলিভারি শুরুতেই থামায় মুশফিকুর রহিমকে। একটু পর সাকিব আল হাসানও যখন বিদায় নিলেন, ৬ উইকেট হারিয়ে ইনিংস তখন টালমাটাল।

কিন্তু লিটন ও মিরাজকে দিশেহারা মনে হয়নি একটুও। প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও তাদের ব্যাটিংয়ে পড়ে পরিস্থিতির প্রভাব। ক্রিজে যাওয়ার পরপরই হামজার বলে দারুণ দুটি শটে চার মারেন মিরাজ। এরপর তিনি ছুটতে থাকেন।

লিটন ক্রিজে থাকার সময় তার চেয়ে বেশি গতিতে রান করা বা তার চেয়ে নান্দনিক শট খেলা অন্য কারও জন্য কঠিন। কিন্তু মিরাজ এ দিন দুই ক্ষেত্রেই ছিলেন এগিয়ে।

লাঞ্চের আগে আর উইকেট হারায়নি বাংলাদেশ। লিটন তখন একটি বাউন্ডারিতে ৪৪ বলে ১৩ রানে অপরাজিত, সাতটি বাউন্ডারিতে ৪৮ বলে ৩৩ রানে মিরাজ।

লাঞ্চের পর লিটন ফেরেন আপন রূপে। শাহজাদের এক ওভারে দুটি চারের পর আরেক ওভারে চার মারেন তিনটি। পঞ্চাশ ছাড়িয়ে জুটি দ্রুতই পেরিয়ে যায় একশ রানও।

পাকিস্তানের কোনো প্রচেষ্টাই কাজে দেয়নি। শুরুতে ৭ রানে ৪ উইকেট শিকার করা শাহজাদের ওপর দিয়ে পরে ঝড় বইয়ে দেন লিটন-মিরাজরা। লেগ স্পিনার আবরার আহমেদ লাইন-লেংথ ধরে রেখে বোলিং করলেও বিপদ ঘটাতে পারেননি। পেসার মোহাম্মদ আলি অসুস্থ হয়ে মাঠের বাইরে যাওয়ায় কঠিন হয়ে ওঠে অন্য বোলারদের কাজও। চোখধাঁধানো কিছু ড্রাইভ খেলেন মিরাজ। লিটন শট খেলেন উইকেটের চারপাশে।

চা-বিরতির একটু আগে ভাঙে বিশ্বরেকর্ড গড়া জুটি। ড্রাইভ করা চেষ্টায় শাহজাদকে ফিরতি ক্যাচ দেন মিরাজ। প্রথমবার টেস্টে ৫ উইকেটের স্বাদ পান এই পেসার। পরের ওভারে তাসকিনকেও দ্রুত ফিরিয়ে ষষ্ঠ শিকার ধরেন শাহজাদ।

১৯৩ রানে ৮ উইকেট হারানো বাংলাদেশের ইনিংস তখন শেষের অপেক্ষায়। লিটন অপরাজিত ৮২ রানে।

কিন্তু হাসান মাহমুদ ক্রিজে গিয়ে দারুণভাবে সঙ্গ দিলেন লিটনকে। ভরসা পেয়ে লিটনও ঠাণ্ডা মাথায় এগিয়ে গেলেন শতরানে। আবরারের বলে চার মেরে সেঞ্চুরি করেন স্পর্শ করেন তিনি ১৭১ বলে।

১৮ ইনিংস পরে এলো তার এই টেস্ট সেঞ্চুরি। একটি রেকর্ডেও উঠে গেল তার নাম। ছয়-সাতে ব্যাট করে দলীয় ৫০ রানের নিচে ক্রিজে গিয়ে তিনটি টেস্ট সেঞ্চুরি করা প্রথম ব্যাটসম্যান লিটনই।

সেঞ্চুরি পর আবার ব্যাট চালিয়ে দ্রুত কিছু রান তোলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তার ইনিংস শেষ হয় সালমান আলি আঘার বলে ছক্কা মারার চেষ্টায়। লং অনে ভালো ক্যাচ নেন সাইম আইয়ুব।

হাসানের সঙ্গে তার দারুণ জুটি থামে ৬৯ রানে। শেষ ব্যাটসম্যান নাহিদ রানাকেও ওই ওভারে ফেরান সালমান। হাসান হার মানেননি।

ব্যাটিংয়ের সাফল্যে উজ্জীবিত হাসান পরে বল হাতেও পান সাফল্য। অনেক বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে উইকেট বিলিয়ে দেন আব্দুল্লাহ শাফিক। পরে দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে তিনি বোল্ড করে দেন নাইটওয়াচম্যান শাহজাদকে।

দিন শেষে ২১ রানে এগিয়ে পাকিস্তান, উইকেট বাকি ৮টি। সিরিজ ড্র করতে হলে জিততেই হবে তাদেরকে। কিন্তু ম্যাচের যা অবস্থা, তাতে হোয়াইটওয়াশ করে সিরিজ জয়ের স্বপ্নও ভালোভাবেই দেখতে পারে বাংলাদেশ।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

পাকিস্তান ১ম ইনিংস: ২৭৪

বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৭৮.৪ ওভারে ২৬২ (সাদমান ১০, জাকির ১, শান্ত ৪, মুমিনুল ১, মুশফিক ৩, সাকিব ২, লিটন ১৩৮, মিরাজ ৭৮, তাসকিন ১, হাসান ১৩*, নাহিদ ০; হামজা ১৬-১-৫০-২, শাহজাদ ২১-৩-৯০-৬, আলি ৭-২-২০-০, আবরার ৩১-৫-৮০-০, সালমান ৩.৪-০-১৩-২)।

পাকিস্তান ২য় ইনিংস: ৩.৪ ওভারে ৯/২

সর্বশেষ

জনপ্রিয়