রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ২৩ ভাদ্র ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ৮ জুলাই ২০২৪

আপডেট: ২৩:১৪, ৮ জুলাই ২০২৪

খেলাপিদের ‘ঋণমুক্ত’ হতে নতুন নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক

খেলাপিদের ‘ঋণমুক্ত’ হতে নতুন নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক

ব্যাংক খাতে খেলাপিদের ‘ঋণমুক্ত’ হতে দিতে নতুন নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যাতে ঋণের ১০ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে সর্বোচ্চ তিন বছরে পুরো টাকা পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।

তবে ঋণের একাংশ পরিশোধ হলেই আগের মতো ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ এখানে রাখা হয়নি, পুরো ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত খেলাপি গ্রাহক ‘খেলাপি’ হিসেবেই চিহ্নিত হবেন। এই সময়ে তিনি নতুন কোনো ঋণও পাবেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) সোমবার এ সংক্রান্ত এক নীতিমালা জারি করেছে। একে ‘এক্সিট পলিসি’ বলছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

এতে বলা হয়েছে, এক্সিট সুবিধার আওতায় এক বা একাধিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করা যাবে।

একাধিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিশোধ সূচি প্রণয়ন করতে হবে। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ সাধারণভাবে ২ বছরের বেশি হবে না। তবে পরিচালনা পর্ষদ যুক্তিসঙ্গত কারণ বিবেচনায় সর্বোচ্চ আরও এক বছর সময় বাড়াতে পারবে।

খেলাপি ঋণ আদায়ে অতীতে নানা সময় নানা সুবিধা দেওয়া হলেও সুফল না পাওয়ার মধ্যে এমন নীতিমালা কেন- এই প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “অনেকেই ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যেতে চান। তবে কোনো নীতিমালা না থাকায় তারা ঋণ শোধ করতে সমস্যায় পড়েন। অনেক সময় ব্যাংকগুলো একেবারে পুরো অর্থ শোধ দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। এতে অনেকেই ঋণ থেকে বেরিয়ে যেতে সমস্যায় পড়েন। নতুন নীতিমালার ফলে ব্যাংকগুলো সুবিধা পাবে এবং ব্যবসায়ীরাও সুবিধামত ঋণ শোধ করে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে পারবেন।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ‘এক্সিট’ নিয়ে কোনো নীতিমালা না থাকার কারণে ব্যাংকগুলো ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এ কারণে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, এভাবে ‘সুযোগ সুবিধা দিয়ে’ খেলাপি ঋণ আদায় হবে না।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এসব ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা। সেটা না করে তাদের নানা রকমের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। এর আগেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণখেলাপিদের নানা রকমের বড় রকমের ছাড় দিয়েছে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

“এটি ব্যাংক খাতের জন্য মোটেই ভালো নয়। ব্যাংক খাতকে ঠিক করতে চাইলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের আইনের আওতায় আনতে হবে।”

২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১১ শতাংশের বেশি।

যা যা আছে নীতিমালায়

আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলেছে, এক্সিট সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরো ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত ঋণের মানের কোনো পরিবর্তন হবে না। এই সময়ে গ্রাহক নতুন ঋণও নিতে পারবেন না। এই সুবিধা নিলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের মধ্যে পুরো ঋণ শোধ করতে হবে।

এই সুবিধা নিলে গ্রাহক ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, ঋণগ্রহীতার ব্যবসা, শিল্প বা প্রকল্প কখনো কখনো বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে বন্ধ হয়ে যায় অথবা লোকসানে পরিচালিত হয়। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা থেকে গ্রাহকের নগদ প্রবাহ বন্ধ বা কিস্তি পরিশোধের জন্য নগদ প্রবাহ অপর্যাপ্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের ঋণ আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে শ্রেণিকৃত হয়ে যায়, যা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি পর্যায়ে পড়ে না।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করে তা কার্যকর করার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংস্থাটি বলেছে, ভবিষ্যতে আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ, এমন বিরূপভাবে শ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে অথবা নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে প্রকল্প বা ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে অথবা ঋণগ্রহীতা কর্তৃক প্রকল্প বা ব্যবসা বন্ধ করার ক্ষেত্রে নিয়মিত ঋণের প্রস্থান সুবিধা দেওয়া যাবে।

বিদ্যমান ঋণস্থিতির ন্যূনতম ১০ শতাংশ এককালীন নগদে পরিশোধপূর্বক এই সুবিধার জন্য আবেদন করতে হবে। ঋণগ্রহীতার আবেদন প্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে ব্যাংক কর্তৃক তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বা নির্বাহী কমিটি দ্বারা এই সুবিধা অনুমোদন হতে হবে। তবে মূল ঋণ সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত এক্সিট সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর অর্পণ করা যাবে।

এ সুবিধার আওতায় সুদ মওকুফ করা হলে মওকুফযোগ্য সুদ আলাদা ব্লকড হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে। সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ বা সমন্বয়ের পর ব্লকড হিসাবে রক্ষিত সুদ চূড়ান্ত মওকুফ হিসেবে গণ্য হবে।

এক্সিট সুবিধার আওতায় ব্যবসায়ীদের ঋণের মান পুরো ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন করা যাবে না।

অর্থাৎ ঋণগ্রহীতারা খেলাপি থাকলে পুরো ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ‘খেলাপি ঋণগ্রহীতা’ হিসেবেই চিহ্নিত হবেন এবং ওই ঋণ হিসাবের তথ্য পূর্ববর্তী শ্রেণি মানের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে রিপোর্ট করতে হবে।

তবে নিয়মিত ঋণে এক্সিট সুবিধা প্রদান করা হলে শুধু এক্সিট হিসেবে রিপোর্ট করতে হবে।

এই সুবিধা গ্রহণকারী যে কেউ ওই ঋণ সম্পূর্ণ পরিশোধ বা সমন্বয়ের পূর্ব পর্যন্ত কোনো নতুন ঋণ নিতে পারবেন না। এক্সিট সুবিধার ঋণ সমন্বয়ের পূর্বে ঋণের বিপরীতে গৃহীত জামানত অবমুক্ত করা যাবে না।

তবে ব্যাংক, গ্রাহক ও ক্রেতা আগ্রহী হলে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে আলোচ্য ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে ঋণ সমন্বয় করা যাবে।

এক্সিট সুবিধা প্রাপ্তির পর গ্রাহক পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণ আদায়ে ব্যাংক প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়