বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪ , ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রকাশিত: ১০:২১, ২১ নভেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১০:২২, ২১ নভেম্বর ২০২৪

মুডি’স রেটিংয়ে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ নামলো, ৬টি ভালো ব্যাংকও নেতিবাচক অবস্থানে

মুডি’স রেটিংয়ে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ নামলো,  ৬টি ভালো ব্যাংকও নেতিবাচক অবস্থানে

বাংলাদেশের সার্বভৌম ঋণমান এক ধাপ অবনমনের পর এবার বেসরকারি খাতের ছয়টি ভালো ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি আমানতের পূর্বাভাস ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক’ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স। এ ব্যাংকগুলো হলো ব্র্যাক, সিটি, ডাচ্‌-বাংলা, ইস্টার্ন, মার্কেন্টাইল ও প্রিমিয়ার ব্যাংক। দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেবল এ ছয়টি ব্যাংকেরই মুডি’স রেটিং রয়েছে। ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানটির সিঙ্গাপুর অফিস থেকে গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

পূর্বাভাস নেতিবাচক করার পাশাপাশি মুডি’সের পক্ষ থেকে দেশের তিনটি ব্যাংকের রেটিংও এক ধাপ অবনমন ঘটানো হয়েছে। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি স্থানীয় ও বৈদেশিক মুদ্রার আমানত রেটিং ‘বি১’ (B1) থেকে ‘বি২’-এ (B2) অবনমন করা হয়েছে। আর মার্কেন্টাইল ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের রেটিং এক ধাপ অবনমন ঘটিয়ে ‘বি২’ থেকে ‘বি৩’-এ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে ‘বি২’ রেটিং অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে সিটি, ডাচ্‌-বাংলা ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ক্ষেত্রে।

মুডি’সের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশের সার্বভৌম রেটিং অবনমনের প্রভাবেই এ ব্যাংকগুলোর রেটিং খারাপ হয়েছে। কারণ কোনো দেশের সার্বভৌম রেটিংয়ের চেয়ে ওই দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের রেটিং বেশি হতে পারে না। রেটিং অবনমন ঘটানোর ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতে বিরাজমান অস্থিতিশীলতা ও ঝুঁকিগুলোকেও আমলে নেয়া হয়েছে।

মুডি’স বলেছে, এক বছরে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ওপর আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। করপোরেট সুশাসনের ঘাটতি, সীমিত স্বচ্ছতা ও অপর্যাপ্ত আর্থিক সুরক্ষা এক্ষেত্রে প্রভাবিত করেছে। তবে সম্পদের গুণগত মানে ঝুঁকি বাড়া সত্ত্বেও রেটিংপ্রাপ্ত অধিকাংশ ব্যাংকের তহবিল ও তারল্য অনেকাংশে স্থিতিশীল রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে মুডি’স।

মুডি’সের রেটিংপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে সরকারি-বেসরকারি খাতে অর্ধশতকেরও বেশি ব্যাংক থাকলেও মাত্র ছয়টি ব্যাংক মুডি’সের রেটিং নেয়ার সাহস দেখিয়েছে। এ ব্যাংকগুলোর কোনো কোনোটি সার্বভৌম রেটিংয়ের চেয়েও ভালো রেটিং পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু সার্বভৌম রেটিং খারাপ হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর রেটিং বাড়ানো যাচ্ছে না। মুডি’স কর্তৃক দেশের সার্বভৌম রেটিং অবনমন করার কারণে ব্যাংকগুলোরও রেটিং অবনমন হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ব্যাংকের রেটিং তো আর কান্ট্রি রেটিংয়ের চেয়ে বেশি হতে পারে না। কান্ট্রি রেটিং অবনমন হওয়ায় মুডি’স রেটিংপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোর রেটিংও কমেছে। ব্যাংক খাতের বিরাজমান সংকট সত্ত্বেও আমাদের মার্কেন্টাইল ব্যাংক ভালো আছে।’

প্রসঙ্গত, এক বছরের মাথায় গত সোমবার দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের সার্বভৌম ঋণমান কমিয়ে দেয় আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও নানা ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে সরকারের ইস্যুয়ার ও সিনিয়র আনসিকিউরড রেটিং ‘বি১’ (B1) থেকে ‘বি২’-এ (B2) অবনমন করে দেয় সংস্থাটি। মুডি’স ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঋণমান সংস্থা দুই বছর ধরেই দেশের ঋণমানে অবনমন ঘটাচ্ছে। বিষয়টিকে দেশের অর্থনীতি ও ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। মুডি’সের তালিকায় বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়া ‘বি২’ রেটিংপ্রাপ্ত দেশগুলো হলো কম্বোডিয়া, মঙ্গোলিয়া, রুয়ান্ডা, নিকারাগুয়া ও পাপুয়া নিউগিনির মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশ।

ঋণমান অবনমনের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতির পূর্বাভাস ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক’ করে দেয় মুডি’স। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্যমতে, ঋণমান ও অর্থনীতির পূর্বাভাস অবনমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদি ইস্যুয়ার রেটিং ‘নট প্রাইম’ বা ‘শ্রেষ্ঠ গুণসম্পন্ন নয়’ হিসেবে অপরিবর্তিত থাকবে।

বিশ্বব্যাপী মুডি’স, এসঅ্যান্ডপি ও ফিচ রেটিং—যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ তিন ঋণমান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান একত্রে ‘বিগ থ্রি’ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের ক্রেডিট রেটিং বাজারের সিংহভাগই এ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে। এ তিন প্রতিষ্ঠানের রেটিংয়ের মধ্য দিয়ে কোনো দেশের অর্থনৈতিক দৃঢ়তা, বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্য আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার প্রকাশ পায়। গত দুই বছরে এ তিন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই বাংলাদেশের ঋণমান কমানো হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ৩১ মে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে ‘বিএ৩’ থেকে ‘বি১’-এ নামিয়ে দেয় মুডি’স। আর ফিচ রেটিংস চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান অবনমন করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সি ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং (আইডিআর) ‘বিবি মাইনাস’ থেকে ‘বি প্লাস’-এ নামিয়ে দেয়া হয়। আর ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের সময় গত ৩০ জুলাই বাংলাদেশের সভরেন ক্রেডিট রেটিং (সার্বভৌম ঋণমান) অবনমন ঘটায় এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষায় দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং ‘বিবি মাইনাস’ (BB-) থাকলেও ওই সময় সেটি কমিয়ে ‘বি প্লাস’ (B+) করে দেয়া হয়।

আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী তিন রেটিং প্রতিষ্ঠান ঋণমান কমিয়ে দেয়ায় বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি তথা বৈদেশিক বাণিজ্যের শর্তগুলো আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গিয়ে দেশের ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত ফি গোনার পাশাপাশি আরো কঠিন শর্তের মুখে পড়তে হচ্ছে। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের সুদও বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সুপরিচিত বৃহৎ ব্যাংকগুলো বাংলাদেশী ব্যাংকের জন্য নিজেদের ক্রেডিট লাইন বা ঋণসীমা কমিয়ে দিচ্ছে বলে ব্যাংক নির্বাহীরা জানিয়েছেন।

ঋণমান আরেক ধাপ কমিয়ে দেয়ার বিষয়ে মুডি’সের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঋণমান অবনমনের সিদ্ধান্তে মূলত বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঝুঁকি বৃদ্ধি ও নিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টিকে প্রতিফলিত করছে। এ বিষয়গুলো এসেছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা থেকে, যার ফলে সরকারও বদলে গেছে। এসব বিষয় সরকারের নগদ অর্থপ্রবাহের ঝুঁকি, বহিঃস্থ দুর্বলতা ও ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।

মুডি’স মনে করে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে ঘাটতি পূরণে আরো বেশি স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। এছাড়া সম্পদের গুণগত মানের ঝুঁকির কারণে ব্যাংক ব্যবস্থার পুঁজি ও তারল্যসংক্রান্ত দুর্বলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে রাষ্ট্রের দায়সংক্রান্ত ঝুঁকিও বেড়েছে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়