ভ্যাট বাড়ার কারণে দাম বাড়ছে বিভিন্ন পণ্যের
রাজধানীর উত্তরার ব্র্যান্ডের একটি পোশাক বিক্রয়কেন্দ্র থেকে গত শুক্রবার কিছু পোশাক কেনেন জাওয়াদ তাজওয়ার। দাম আসে ১ হাজার ৫৭৭ টাকা, কিন্তু তাঁকে পরিশোধ করতে হয়েছে ১ হাজার ৭৩৪ টাকা। বাড়তি ১৫৭ টাকা তাঁকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) হিসেবে দিতে হয়েছে।
সরকার ৯ জানুয়ারি ব্র্যান্ড ও নন–ব্র্যান্ডের পোশাকের ওপর ভ্যাট হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করে। পরে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে তা কমিয়ে ব্র্যান্ডের পোশাকে ১০ শতাংশ ও নন-ব্র্যান্ড পোশাকে আগের মতো সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়। ফলে ব্র্যান্ডের পোশাকে আগের চেয়ে বাড়তি ভ্যাট আরোপ হয় আড়াই শতাংশ। এতে পোশাক কিনতে গিয়ে জাওয়াদ তাজওয়ারকে বাড়তি দিতে হয়েছে ৩৯ টাকা।
পোশাকের দেশি ব্র্যান্ডের উদ্যোক্তাদের সংগঠন ফ্যাশন উদ্যোগের সাবেক সহসভাপতি সৌমিক দাস বলেন, নতুন ভ্যাট হার কার্যকর করা শুরু হয়েছে। এতে বেচাকেনা আরও কমেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ এমনিতেই পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছিলেন।
সরকার নতুন করে ভ্যাট আরোপের কারণে পোশাকের পাশাপাশি আমদানি করা ফল, টিস্যু, রান্নার গ্যাস, মিষ্টি, বিস্কুট, ফলের জুস, ড্রিংক, টমেটো কেচাপ, রং, সিনেমার টিকিট, চশমার ফ্রেমসহ বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন খাতে বাড়তি ভ্যাট আদায় শুরু হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে নতুন চালানের পণ্য বাজারে এখনো আসেনি। নতুন পণ্য এলে দাম বাড়বে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা আশা করছেন, বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহার করা হবে।
যেমন যন্ত্রে উৎপাদিত বিস্কুট, কেক, আচার, চাটনি, টমেটো পেস্ট, টমেটো কেচাপ, টমেটো সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প ইত্যাদি পণ্যের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। ফলের রস ও ফ্রুট ড্রিংকসের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
২৩ জানুয়ারি এ খাতের উদ্যোক্তারা এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানোর ফলে ৫ টাকার বিস্কুট ৭ টাকা, ১০ টাকার বিস্কুট ১৩ টাকা, ২০ টাকার জুস ২৫ টাকা ও ২৫ টাকার জুস ৩৩ টাকা হবে। তিনি গত শনিবার বলেন, ‘ভ্যাট বাড়ানো হলেও আমরা এখনো দাম বাড়াইনি। বাড়তি ভ্যাটের টাকা আমরা কোম্পানি থেকে ভর্তুকি হিসেবে দিচ্ছি। কারণ, আমরা আশাবাদী সরকার মানুষের ওপর খরচের এই বাড়তি চাপ তুলে দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। এ জন্য আমরা আরও এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে চাই।’
সরকার ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। পরে সমালোচনার মুখে ২২ জানুয়ারি আট ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাটের আগের পর্যায়ে নেওয়া হয় অথবা কিছুটা কমানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে ওষুধ, মুঠোফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহার, রেস্তোরাঁর খাবার, পোশাক, মিষ্টি, নন-এসি হোটেল, মোটর গাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ। তবে বাকি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাটের হার আগের জায়গায় ফেরেনি।
সরকার কর বাড়িয়ে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের উদ্যোগ নিয়েছিল। সরকারের উপদেষ্টারা বলছিলেন, কর বাড়ানো হলেও মানুষের ওপর খুব বেশি চাপ তৈরি হবে না। কারণ, বিভিন্ন নিত্যপণ্যে আগেই শুল্ক-কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদেরা বলছিলেন, চড়া মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির মধ্যে শুল্ক-কর বাড়ানো ঠিক হয়নি। আগামী বাজেট পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেত। ধনীদের ওপর কর বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ওপরও দেওয়া দরকার।
ফলের দাম বেড়েছে
আমদানি করা আপেল, নাশপাতি, মাল্টা, আঙুরসহ বিভিন্ন ফলের ওপর আগে থেকেই উচ্চহারে শুল্ক–কর রয়েছে। ৯ জানুয়ারি ফল আমদানিতে সম্পূরক শুল্কহার ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর ও আমদানিকারক সূত্রে জানা গেছে, সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর কারণে প্রতি কেজি মাল্টা আমদানিতে এখন ১১৬ থেকে ১১৭ টাকা শুল্ক–কর দিতে হচ্ছে। বাড়ানোর আগে এই শুল্ক–কর ছিল ১০১-১০২ টাকা।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে গত কয়েক দিনে দেখা গেছে, আপেল, কমলা, মাল্টা, আঙুরের দাম চড়া।
ঢাকার তোপখানা রোডের মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে ফুটপাতে বসে ফলফরাদি বিক্রি করেন মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে ১৪ কেজি ওজনের মাল্টার কার্টনের দাম বেড়েছে ২০০ টাকা। খুচরা পর্যায়ে তিনি প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি করছেন ৩২০ টাকা। প্রতি কেজিতে ২০ টাকা দাম বাড়িয়েছেন।
মকবুল হোসেনের দোকানে ফল কিনতে দর-কষাকষি করছিলেন মিরপুরের বাসিন্দা ইলিয়াস হোসেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এখন শুধু বাচ্চাদের জন্য ফল কিনি, নিজেরা খেতে পারি না। কেনা আরও কমিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, শুল্ক–কর বাড়ানোর পর দুই সপ্তাহে ১ হাজার ৬৯৬ টন মাল্টা আমদানি হয়েছে। এ থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। শুল্ক–কর বাড়ানোর কারণে আড়াই কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব পাওয়া গেছে।
কিশমিশ আমদানিতে প্রতি কেজিতে শুল্ক-কর ছিল ২৯১ টাকা। সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর পর ২০০ টন কিশমিশ খালাস হয়েছে। তাতে প্রতি কেজিতে শুল্ক–কর দিতে হয়েছে ৩৩৩ টাকা, অর্থাৎ প্রতি কেজিতে শুল্ক–কর বেড়েছে ৪২ টাকা।
রঙের দাম বেড়েছে ৪-৫%
সরকার এ দফায় সরবরাহ পর্যায়ে রঙের ওপর সম্পূরক শুল্কহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করেছে। ফলে স্থানীয় রং উৎপাদকদের ওপর করের ভার বেড়ে যায়। গত রোববার থেকে খুচরা পর্যায়ে নতুন দর কার্যকর করেছেন রং উৎপাদকেরা। দাম গড়ে ৪-৫ শতাংশ বেড়েছে।
কারওয়ান বাজারে রঙের দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, একটি সুপরিচিত ব্র্যান্ডের ৩ দশমিক ৬ লিটারের এক কৌটা রঙের দাম ১০০ টাকার মতো বেড়ে ১ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ওই বাজারের সাদ্দাম পেইন্ট ও হার্ডওয়্যারের ম্যানেজার মো. শিহাব বলেন, দুই দিন আগে বাজারে বাড়তি দামের রঙের চালান ঢুকেছে।
এদিকে ভ্যাট বাড়ানোর পর ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ১২ কেজির সিলিন্ডারের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম চার টাকা বাড়িয়েছে। নতুন দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪৫৯ টাকা। যদিও সরকার নির্ধারিত দর কেউ মানেন না। ক্রেতারা অভিযোগ করছেন, ভ্যাট বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে তাঁদের কাছ থেকে আরও বাড়তি টাকা নেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রামের হালিশহরে এলপি গ্যাস সরবরাহকারী গোলাম হাক্কানী বলেন, কোম্পানিভেদে এলপি গ্যাসের দাম ভিন্ন। ভ্যাট বাড়ানোর সুযোগে কেউ কেউ ৫০ টাকা দাম বাড়িয়েছে।
এখনো বাড়েনি, বাড়বে
চশমার প্লাস্টিক ফ্রেম, মেটাল ফ্রেম ও সমজাতীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ঢাকার বিজয়নগরের আকরাম টাওয়ারের চশমার দোকানগুলো ঘুরে গত রোববার দেখা যায়, নতুন চালানের পণ্য এখনো বাজারে আসেনি। বিপণিবিতানটির কিং অপটিক্যালসের কর্ণধার মো. মারুফ বলেন, ‘আমার দোকানে সর্বনিম্ন ৬০০ টাকায় চশমার ফ্রেম পাওয়া যায়। বাড়তি ভ্যাট আরোপ হলে দাম বাড়বে আরও ৫০ টাকা।’
দরজির দোকান, সিনেমার টিকিট, টিস্যু ইত্যাদি পণ্য ও সেবার দাম শিগগিরই বাড়তে পারে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
শিল্পের কাঁচামালের ওপর বাড়তি শুল্ক–কর ও বাড়তি লেনদেন কর (টার্নওভার ট্যাক্স) পরোক্ষভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। ভ্যাট বাড়ানোর তালিকায় আছে ইস্পাতশিল্পের বিভিন্ন উপকরণ, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, রাবার প্রসেসিং অয়েল, বিটুমিন ইত্যাদি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক–কর পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলবে।
এদিকে টার্নওভার করের আওতায় তালিকাভুক্তির সীমা বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ থেকে কমিয়ে ৩০ লাখ টাকা করা হয়েছে। মানে হলো আরও কম পরিমাণ পণ্য বিক্রি করা ব্যবসায়ীরা করের আওতায় চলে এলেন। তাঁদের ক্ষেত্রে (৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত) করহার মোট লেনদেনের ৪ শতাংশ।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শুল্ক-কর বাড়ানোর ফলে শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর জীবনে বেশি প্রভাব পড়ছে। খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। সরকার রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য সহজ পথে গেছে। কিন্তু যাঁরা কর ফাঁকি দিচ্ছেন, তাঁদের প্রকারান্তরে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘রাজস্ব বাড়াতে প্রত্যক্ষ বাড়ানোর জোর দেওয়া উচিত। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে সেই উদ্যোগ দেখছি না। অথচ রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে এ ধরনের সরকারের কাছে এমন কঠোর নীতির প্রত্যাশা বেশি।’