পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলে
জাফলং সম্পর্কে আমার আগে তেমনটা জানা ছিল না। কখনো সেখানে যাওয়া হয়নি কিংবা জাফলং সম্পর্কে তেমনটা জানার সুযোগও হয়নি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সফর থেকে ঘুরে আসার পরে মনে হচ্ছে আমার হৃদয়টা সেখানে রেখে এসেছি। মনটাও বারবার টানে আবার সেখানে যাই। গিয়ে দেখি পিয়াইন নদীর সচ্ছ-পানির মধ্যে সুন্দর, সুন্দর পাথরের উপর দিয়ে মাছেদের ছুটে চলা কিংবা খাসিয়াদের সেই মাচার উপরে তৈরি ঘরগুলো। সেই সাথে পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা সেই সবুজ দীপ্ত চা-বাগান দেখলে মনে হয় যেন স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করছি।
নতুন বছরের শুরুতেই ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলো। নতুন চেয়ারম্যান এসেই ঘোষণা করলেন, আপনাদের জন্য শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হবে। আপনারা সবাই মিলে একটা ভালো দর্শনীয় স্থান নির্ধারণ করুন।
বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্থানের ধারণা দিলেও জাফলং যাওয়ার বিষয়ে আমি ও আমার সহপাঠীরা ছিলাম অনড়। সিদ্ধান্ত হলো, ১৪ ফেব্রুয়ারী সারারাত বাস ভ্রমণ শেষে পরদিন সকাল-সন্ধ্যা জাফলংসহ কিছু দর্শনীয় স্থানে কাটানো।
দুটো বাসে করে আমরা ৯০ জন রওনা দিলাম ও সকালে গিয়ে প্রথমেই পৌঁছালাম যাঁর হাত ধরে আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে বাংলাদেশের বুকে ইসলামের আগমন ঘটে সেই সূফী সাধক হযরত শাহজালাল (রহ:)’র মাজারে। মাজার জিয়ারত শেষে দেখলাম বিখ্যাত জালালি কবুতর ও মাজারের পুকুরের গজার মাছ।
সবাই মিলে সকালের নাস্তা সেরে রওনা দিলাম জাফলং।
বাসে জাফলং যাওয়ার সময় পাহাড়ে ঘেরা দৃষ্টিনন্দন চা-বাগান থেকে নববসন্তের নির্মল বাতাস এসে হৃদয় জুড়িয়ে দিল। জাফলং পৌছে বাস থেকে নেমে সামনে এগোতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো, ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের বুকে গড়ে ওঠা ভারতের ডাউকি। পাহাড়ের বুকে ধাপে ধাপে খাঁজ কেটে তৈরি দৃষ্টিনন্দন খাসিয়াদের বাড়িগুলো দেখতে আমাদের কাছে মনে হলো যেন স্বপ্নপুরী।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখতে পাচ্ছিলাম, জাফলংয়ের বিখ্যাত স্বচ্ছ পানির পিয়াইন নদী ও তার চারিদিকে ছোট বড় দৃষ্টিনন্দন সব পাথর। হাজারো দর্শনার্থী পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কী বসে বিভিন্ন আঙ্গিকে ছবি তুলছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ উপভোগ করার পরে হোসাইন মাহমুদ স্যারের সঙ্গে কয়েকজন মিলে পিয়াইনের স্বচ্ছ-শীতল পানিতে নেমে সাঁতার কাটলাম। মনে হচ্ছিল, যেন সকলেই নিজেদের ছেলেবেলায় ফিরে গেছি। সবাই প্রাণ খুলে সাঁতার কেটে মনকে শীতল করলাম।
তারপর সিদ্ধান্ত হলো, খাসিয়া পল্লীতে যাব। নৌকায় খাসিয়া পল্লীতে রওনা হলাম। বিচিত্র রঙের পাথরের মধ্য দিয়ে ছুটে চলা পিয়াইনের স্বচ্ছ পানির উপর দিয়ে নৌকা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন কাঁচের উপর দিয়ে যাচ্ছি। ছোট ছোট মাছেরা আমাদের সাথে ছুটে চলছে।
হঠাৎ ভারতের ডাউকি অঞ্চল থেকে একদল খাসিয়া মেয়ে এসে পিয়াইন নদীতে নামলো। আমাদের মনে হচ্ছিল, স্বর্গ থেকে একদল উর্বশী সরোবরের স্বচ্ছ পানিতে গোসল করছে। সাথে খাসিয়া বাচ্চাগুলোর নদীতে পাথর ছুঁড়ে খেলতে দেখার অনন্য দৃশ্য মনের কোঠায় জমে রইল।
এরপর অটোরিকশায় চললাম খাসিয়া পল্লীর দিকে। শত, শত সুপারি বাগানের মধ্যে গড়ে ওঠা খাসিয়া পল্লীতে মাচার উপরে তৈরী করা বাড়িগুলোর দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করে তোলে। তাদের অপরূপ জীবন ও সংস্কৃতি উপভোগ করে সবাই মিলে সবুজে ঘেরা চা-বাগানে গিয়ে ঘুরাঘুরি করলাম। অবশেষে রাতের খাবার খেয়ে বাসে ফিরতি পথে রওনা হলাম।
লেখা ও ছবি : বেলাল হোসাইন বকুল, সমাজকর্ম বিভাগ (৩য় বর্ষ)
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।